"ইফতারিসহ সকল খাদ্যের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা চাই"- পবা'র মানববন্ধন
“ইফতারিসহ সকল খাদ্যের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা চাই” শ্লোগানকে সামনে রেখে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদ এর যৌথ উদ্যোগে এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনের অংশগ্রহণে ০৫ জুলাই ২০১৩, শুক্রবার, সকাল ১১টায় চকবাজার শাহী মসজিদের সামনে আয়োজিত হলো এক মানববন্ধন।
মানববন্ধন থেকে জানানো হয়-প্রতিটি ভোক্তার নিরাপদ ও ভোজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ- মাংসসহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে এবং সাম্প্র্রতিক সময়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) -এর ঢাকার বাজারে মৌসুমী ফলে ফরমালিন পরীক্ষার ফলাফলে বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
নানা ধরনের বিষাক্ত ও নিম্নমানের খাদ্যের কারণে আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের মধ্যে প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয় যেমন রয়েছে, তেমনি আছে শাক সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, মিষ্টি। ভেজাল খাদ্যে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। কিছু খাবার এমনই বিষাক্ত যে তা ডিএনএকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। উৎপাদিত, প্যাকেটকৃত, প্রক্রিয়াজাত তরল ও কঠিন খাদ্যের অধিকাংশই বিষ ও ভেজালে ভরপুর। ফল কৃত্তিম উপায়ে পাঁকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন, কৃত্রিম ক্রমবৃদ্ধি নিয়ামকসহ বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক এবং তাজা ও সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে । মিষ্টিতে কৃত্রিম মিষ্টিদায়ক, আলকাতরা এবং কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়। মাছে ফরমালিন, শাকসবজিতে কীটনাশক ও ফরমালিন, শুটকিতে ডিডিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন ফলের রস, স্ন্যাকফুড, জ্যাম-জেলী, আচার-চাটনীতে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রং ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে এসবের প্রভাবে গলায় ক্যান্সার, রক্ত ক্যান্সার, বাল্য হাঁপানি এবং চর্ম রোগ হয়। ফরমালিনযুক্ত খাবার মানুষের শরীরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এতে পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, অস্থিমজ্জা জমে যায়। এর ফলে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী মহিলারা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার পচে যাওয়া, রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া, অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।
দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসার সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, নির্বাহী সদস্য এ কে এম সেরাজুল ইসলাম, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, পীসের মহাসচিব ইফমা হোসেন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, গ্রীন মাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো: সেলিম, হাজারীবাগের সাধারণ সম্পাদক জি এম রুস্তম খান প্রমুখ। এছাড়াও পুরান ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনের (ইসলামবাগ অনির্বাণ যুব সমাজ কল্যাণ সংঘ, বড় কাটরা সমাজ কল্যাণ পরিষদ, কামালবাগ যুব সমাজ কল্যাণ সংসদ, মুসলিম যুব সংঘ, চাম্পাতলী প্রতিভা সংঘ, মিট এন্ড ফ্রেন্ডস সোসাইটি, বাংলাদেশ মানবাধিকার ও নির্যাতন দমন সোসাইটি, ঢাকা ওয়েল ফেয়ার ক্লাব) নেতৃবৃন্দসহ শত শত মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেন।
বক্তারা জানান, রমজানে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। এসব খাবার ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সরকারের ভেজাল বিরোধী অভিযান সত্বেও বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্য ব্যবসায়ীদের উপর কোন প্রভাব পড়ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা পংঙ্গু জাতিতে পরিনত হব । বিষাক্ত খাদ্য নিরব ঘাতক হিসাবে কাজ করছে। ভ্রাম্যমান আদালত গণহত্যামূলক এ অপরাধে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করার ফলে তাদের তান্ডবতা বেড়েই চলছে।
মানব বন্ধনে পবা এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষথেকে দশ দফা দাবি পেশ করা হয় এগুলো হলোঃ
১. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত ও রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়। এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই আইনের ২৫-গ ধারায় খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল খাবার বিক্রয়ের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
২. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. খাদ্যে বিষ মেশানোর সাথে জড়িত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
৪. ভেজাল বিরোধী টিম নিয়মিতভাবে খেজুরসহ অন্যান্য ফল, সকল খাদ্য মজুদকারী গুদাম/কারখানা /মোকাম পরিদর্শন করতে হবে।
৫. খাদ্যে বিষ মিশ্রন/ভেজালকারীদের ধরার জন্য একটি সেল গঠন করে ফোন/ফ্যাক্সসহ সাধারণ মানুষের কাছে থেকে সংবাদ গ্রহণের জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করা।
৬. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং পরিদর্শন ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের সাধন।
৭. পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা।
৮. গণমাধ্যমে প্রচার- প্রচারণার মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষয়ে সচেতন করা।
৯. ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন সর্বশান্ত হচ্ছে। তাছাড়া রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। রাসায়নিকের মিশ্রণে বিষাক্ত খাদ্যের কারণে সৃষ্ট এ বিপর্যয় রোধে সরকারীভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।
১০. শুধুমাত্র খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ভেজাল বিরোধী অভিযান বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার বিপরীতে যথেষ্ট নয়। বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে খাদ্যে বিষ মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক