উপকূলে চিংড়ি চাষঃ লাভ ক্ষতির খতিয়ান প্রয়োজন আছে কি??

তানভীর হোসেন

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি শিল্প অনেক বড় একটি অংশ যা অর্থনীতির স্বাভাবিক অগ্রগতিকে চলমান রাখতে কার্যকরভাবে সহায়তা করে। চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশের রপ্তানিশিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত যা প্রতিবছর জাতীয় রিজার্ভে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রার যোগান দেয়। চিংড়ি শিল্প হয়ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে কিন্তু এর জন্য আমাদের নিজেদেরকে কতটুকু মূল্য দিতে হচ্ছে তা হয়ত খুব একটা প্রকাশ পায় না।

shrimp 4

চিংড়ি চাষের জন্য লবনাক্ত পানি সবচেয়ে উপযোগী। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশেই চিংড়ি চাষ হচ্ছে। চিংড়ি চাষ অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা ধানের পরিবর্তে চিংড়ি চাষকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ধান চাষের প্রতিকুলতা কৃষকদের চিংড়ি চাষে অনুপ্রানিত করছে। চিংড়ি চাষের বিস্তার উপকূলীয় পরিবেশের উপর মারাত্নক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার আক্রান্ত এলাকায় সাধারন কৃষি ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।

উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমির পরিমান দিন দিন হ্রাস  পাচ্ছে। স্বল্প শ্রমে এবং তুলনামূলক কম মূলধনে অধিক মুনাফা লাভের জন্য কৃষকরা চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির অত্যধিক চাহিদাও কৃষকদের চিংড়ি চাষে উৎসাহিত করছে যার ফলে ধান অথবা অন্য কোন শস্য উৎপাদনে কৃষকরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সমূদ্রের পানি যাতে স্থল এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ১৯৭০ সালে সরকার উপকূলীয় এলাকায় কিছু নিম্নভূমির জলাশয় তৈরি করেছিল। উক্ত জলাশয়গুলোতে বর্তমানে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে যার ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাটির কৃষি উপযোগিতাও হ্রাস পাচ্ছে।

Bangladesh Climate Change

চিংড়ি চাষের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ দারুন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতির মধ্যে মাটি ও পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া, জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়া, জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া, বিশুদ্ধ পানির অভাব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

জমির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পায় নানা কর্মকান্ডের ফলে যেমন বাগদা ঘেরের অপরিকল্পিত প্রসারন, সংলগ্ন এলাকায় লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, ভূগরভস্থ পানিতে লবনাক্ত পানির প্রবেশ, জলাবদ্ধতা, নদী ও খালে লবনাক্ত পানির প্রবাহ, চিংড়ির অধিক বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত লবন যোগ করা। এসকল কারনে ভূমির উপরে ও নিচে মাটি ও পানির লবনাক্ততা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চিংড়ি চাষের ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাটির উর্বরতাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। লবনাক্ততার কারনে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, ফল এবং সবজির উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। চিংড়ি চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে শস্যের উৎপাদন এবং মাটিতে জৈবউপাদানের পরিমানও হ্রাস পায়।

চিংড়ি চাষের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দেয়। চিংড়ি চাষে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানুষের চর্মরোগ ও আন্ত্রিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, সাধারন মানুষের অপষ্টির ঝুঁকি বাড়ে। অস্বাস্থ্যকর চিংড়ি প্রক্তিয়াজাতকরন, চিংড়ি বর্জ্যের যত্রতত্র নিষ্কাশনের কারনেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রানিবৈচিত্র্যের উপর চিংড়ি চাষের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। চিংড়ি চাষের জমির জন্য বন্যপ্রানী, পাখি প্রভৃতির আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়। চিংড়ি চাষের ফলে গৃহপালিত পশুর জন্য ঘাস জমি এবং চারনভূমি কমে যায় যা এদের অস্তিত্বের উপর হুমকিস্বরুপ। অনেক এলাকায় গৃহপালিত পশুর সংখ্যাও খুবই কমে গেছে। চিংড়ি শুঁটকি সংগ্রহের সময় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রানীদেরও ধ্বংস করা হয়। চিংড়ি চাষের প্রসারনের ফলে স্থানীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা ইত্যাদির চাষও কমে এসেছে।

shrimp 5

বিশুদ্ধ পানির পরিমান ও গুনাগুনের উপরও চিংড়ি চাষের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ঘের প্রসারনের কারনে মিঠাপানির পুকুরের পরিমান হ্রাস পেয়েছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পানিও মারাত্নকভাবে দূষিত হচ্ছে। চিংড়ি চাষের ফলে উক্ত এলাকায় সেচের পানিরও অপরিসীম অভাব দেখা দেয়।

চিংড়ি চাষ মানুষের উপর নানা ধরনের সামাজিক প্রভাব ফেলে। এসকল সামাজিক প্রভাব যেসব ক্ষত্রে পড়ে তার মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার, কর্মসংস্থান, আয়, সাধারন সম্পদের সহজলভ্যতা, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সামাজিক মর্যাদা, লিঙ্গ, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। গ্রামীন অর্থনীতিতে অধিকাংশ জমিতে চাষ হয় বর্গা পদ্ধতিতে যেখানে জমির মালিক কর্তৃক প্রান্তিক কৃষকদের বর্গা দেয়া হয়। কিন্তু চিংড়ি চাষে জমির মালিক নিজেই তা তত্ত্বাবধান করেন যার ফলে প্রান্তিক কৃষক চাষের জমি না পেয়ে বেকার হয়ে পড়ে যা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে। এভাবে সমাজে দারিদ্রতার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে শ্রেনীবৈষম্যের শিকার হচ্ছে সমাজের একটি বড় অংশ।

চিংড়ি শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এটা যেমন সত্য তেমনি এই শিল্প আমাদের আভ্যন্তরীন অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ এবং স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি সার্বিক ইতিবাচক পদ্ধতিতে চিংড়ি শিল্পকে সাজালে হয়ত এসকল সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics