এল সজল ঘন বরষা

প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন জাগানো বর্ষা এল। আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। আকাশে ধূমল মেঘের ভেলা ভাসিয়ে নদী-মেখলা শ্যামলী নিসর্গের আমাদের এই বদ্বীপে বর্ষার আগমন যেমন চিরচেনা, তেমনি বিপুল প্রত্যাশিতও। 2013-06-14-19-25-27-51bb6e27a61c2-untitled-10
আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণ গ্রীষ্মের তপ্ত-শুষ্ক মাটিকে ভিজিয়ে কোমল করে তোলে। বীজ থেকে সুপ্ত অঙ্কুর মাথা তোলে সেই নরম মাটি ভেদ করে। সতেজ হয়ে ওঠে গাছের মলিন পাতা। গাঢ় সবুজে ভরে ওঠে তরুপল্লব। বুনো উচ্ছ্বাসে বেড়ে ওঠে লতাগুল্ম। দেশের কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে এই বৃষ্টি রেখে চলেছে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক ভূমিকা। উপরন্তু বাদল দিনের আর্দ্র কোমল হাওয়া সবার তাপদগ্ধ প্রাণে বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির পরশ। ক্লান্তি-অবসাদ ঘুচিয়ে ফিরিয়ে আনে উদ্দীপনা। জীবনের এমন সর্বব্যাপী আবাহনই বর্ষাকে আমাদের জনজীবনে আদরণীয় করেছে, দিয়েছে অনন্যতা। বাঙালির সৃজনশীলতায় যুগে যুগে তাই বর্ষাবন্দনায় কোনো ক্লান্তি নেই, নেই কোনো বিরাম।
বাংলার ঋতুচক্রে প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তাদের রয়েছে এমন বিশেষ কিছু অনুষঙ্গ, যা তাদের পরিচয়ের প্রতীক হয়েই প্রতিভাত হয়েছে। বর্ষার ক্ষেত্রে তেমনই অবিচ্ছেদ্য প্রতীক বৃষ্টিভেজা কদম ফুল। এ আমাদেরই নিজস্ব ফুল। কদমের পাশাপাশি পদ্মার ইলিশ, ব্যাঙের ডাক আর মেঘলা দিনে রবীন্দ্রনাথের গান। ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে’ কিংবা ‘উতল-ধারা বাদল ঝরে। সারা বেলা একা ঘরে’, ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা/ অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা’—কতভাবেই না তিনি অনুভব আর উপলব্ধি করেছেন বর্ষাকে। বৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে কবির সুর মিলে গিয়ে বাঙালির শ্রবণে-চিত্তে যেন চিরন্তন ঐকতান হয়ে বেজে চলেছে।
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান’—বর্ষার প্রকৃতির রূপটাই পাল্টে যায়। ‘ভরা নদী ক্ষুরধারা’। দুকূল ভাসিয়ে তাদের ছুটে চলা। খালবিল টইটম্বুর। জাল নিয়ে নতুন পানিতে মাছ ধরার আনন্দ উত্তেজনা গ্রামীণ জনপদে। ভেজা বাতাসে ফুলের সুবাস। কদম-কেয়া-চালতায় নিসর্গের সাজসজ্জা। আকাশে গুড়গুড় মেঘের ডাক। থেকে থেকে বিজলি চমক। ঝমঝম করে নেমে পড়া মুষলধারায় ঝাপসা দিগন্ত। পরিবেশটাই যেন মনের গহিন থেকে তুলে আনে এক অনির্বচনীয় ব্যথা। মনে করিয়ে দেয় ভুলে থাকা কোনো অচরিতার্থ অভিলাষকে। জাগিয়ে তোলে না পাওয়ার কোনো বেদনা। মিলে যায় বিরহের সঙ্গে। মনে হয় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। কিন্তু যদি তা না বলা যায়? তবে মন থেকে যায় না সেই না-বলার ভার। মেঘলা আকাশের মতো মনও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
বর্ষার কিছুটা বিড়ম্বনাও আছে বৈকি। বিশেষত নগরজীবনে। রাজধানীতে নিষ্কাশনব্যবস্থায় এমন বেকায়দা যে এক পশলা ভারী বর্ষণেই রাজপথ এঁদো ডোবায় পরিণত। পথে দুর্বিষহ যানজট। সাধারণ লোকের প্রধান বাহন রিকশার ভাড়া বেড়ে যায়। শহুরে লোকের তো হরেক রকম কাজে ব্যস্ততার অন্ত নেই। কাজে বেরিয়ে আচমকা বৃষ্টিতে পড়ে আধভেজা হয়ে আটকে থাকতে হয় পাশের দোকানের ছাউনির তলায় বা অফিসের বারান্দায়। জলমগ্ন পথে খোলা ম্যানহোল বা গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই। ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুতের তারের স্পর্শে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে কখনো কখনো। কিন্তু এর জন্য তো আর বর্ষা দায়ী নয়, ঘাটতি আমাদের ব্যবস্থাপনায়। কাজেই বর্ষা ঝরে পড়ুক তার অমিয় ধারায়।

আশীষ-উর-রহমান

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (১৫/০৬/২০১৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics