কাঞ্চনজঙ্ঘার পথে
কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়েছিলেন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী এম এ মুহিত। অবাক পৃথিবীর পাঠকদের সে গল্পই শোনাচ্ছেন মুহিত
বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা। ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট উঁচু। আকাশ পরিষ্কার থাকলে নেপাল ও ভারতের সীমান্তের এই পর্বতশৃঙ্গটি দেখা যায় আমাদের দেশের ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম থেকেও। ভারতের সিকিমের মানুষের কাছে এটি ‘পবিত্র পর্বত’ (হলি মাউনটেন)। সেদিক দিয়ে যাওয়াটা নিষিদ্ধ। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের জন্য এমনকি ভারতীয়দেরও যেতে হয় নেপাল দিয়ে। খ্যাতি আছে খুনে পর্বত হিসেবেও। মৃত্যুর হার ২১.৪ শতাংশ। পর্বতে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক মৃত্যুর হার। যেখানে এভারেস্টে মৃত্যুর হার মাত্র ৫.৭ শতাংশ। এমন বিপজ্জনক পর্বতে অভিযানের পরিকল্পনা আঁটছিলাম বহুদিন ধরেই। শেষমেশ ঠিক করা হলো, কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে যাব এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। তবে স্পন্সর জোগাড় হতে সময় লেগে গেল। অবশেষে পাওয়া গেল তিন স্পন্সর প্রতিষ্ঠান- গ্রামীণফোন, এ কে খান অ্যান্ড কম্পানি লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড।
কাঠমাণ্ডুর পথে
সবকিছু চূড়ান্ত করে ১৯ এপ্রিল চড়ে বসলাম বিমানে। সকালের ফ্লাইটে চলে গেলাম কাঠমাণ্ডু। দুই দিন কেটে গেল পর্বতারোহণের অনুমতি যোগাড় এবং কেনাকাটা করতেই। ২১ এপ্রিল আবার চড়ে বসলাম বিমানে। কাঠমাণ্ডু থেকে ৪৫ মিনিটে চলে এলাম নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় ছোট শহর ভদ্রপুরে। গাইড মিংমা গ্যালজে শেরপাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে তারপর ইলাম। এটিই কাঞ্চনজঙ্ঘা যাওয়ার রুট। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এলো। রাতটা কাটাতে হলো হোটেলে। পাহাড়ের ওপর ছোট্ট শহর ইলাম। পরদিন সকালে নাশতা সেরে জিপে চড়ে বসলাম। গন্তব্য তিন হাজার ৯৩৭ ফুট উঁচু সিনাম।
পথ হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বাঁকে
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলছে জিপ। মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছি। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। সবকিছু গুছিয়ে জিপ থেকে নেমে পড়লাম। রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে লাগলাম। এভারেস্ট বা অন্নপূর্ণা অভিযানে যাওয়ার পথগুলো সারা বছরই অভিযাত্রীদের ভিড়ে জমজমাট থাকে। থাকা-খাওয়া নিয়ে ভাবতে হয় না। তবে দুর্গম ও বিপজ্জনক কাঞ্চনজঙ্ঘায় অভিযান হয় খুবই কম। তেমন ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। রাত কাটালাম লিম্বু আদিবাসী এক পরিবারের বাড়িতে। মাটির ঘরে, এক খাটে দুজনে শুয়ে পড়লাম চাপাচাপি করে। ঘুম থেকে উঠলাম খুব ভোরে। রাতে থাকতে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে নাশতা সেরে শুরু হলো হন্টন। বাকি পথটুকু যেতে হবে এভাবেই।
ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৩ এপ্রিল। চলেছি উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে। চারপাশে কেবল পাহাড়। শান্ত নিরিবিলি আবহাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে পেটে খিদে মোচড় দিয়ে উঠল। আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম এক বাড়িতে গিয়ে। রান্নাটা নিজেই করেছি। সামান্য বিশ্রাম দিলাম পা জোড়াকে। তারপর আবার শুরু হলো হাঁটা। আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছি ওপর দিকে। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যে। চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ছয় হাজার ২৮৩ ফুট উঁচুতে খেবাং গ্রামে। এক লিম্বু পরিবারের ছোট্ট ঘরে কোনোমতে রাত কাটালাম। বেশ দরিদ্র এই আদিবাসী পরিবারগুলো। তবে অভাব তাদের মুখের সরল হাসি মুছে দিতে পারেনি।
২৪ এপ্রিল সকালে ফের চলা শুরু হলো। উঠে যাচ্ছি আরো উঁচুতে। নেপালের এই জায়গাগুলো খুব স্বাস্থ্যকর। আসলেই শরীরটা ভালো হয়ে যায়। মনে হয় যেন ঝরঝরে হয়ে গিয়েছি। ক্লান্তির লেশমাত্রও থাকে না। আমার অবশ্য দমের কোনো ঘাটতি নেই। আস্তে আস্তে হাঁটছি। থেকে থেকে শুনছি পাখির কলতান, গাছে গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে বুনোফুল। নেপালের জাতীয় ফুল রডোডেনড্রন। বাড়িতে বাড়িতে লাল, বেগুনি নানা জাতের ফুলের সমারোহ। সেসব দেখতে দেখতে বিকেলে চলে এলাম ইয়ামফুদিন। ছয় হাজার ৫৩৫ ফুট উঁচু ছোট্ট একটা জায়গা। ইয়ামফুদিনে শেরপাদের বসবাস। রাতটা এক শেরপা বাড়িতে কাটিয়ে দিলাম। ২৫ এপ্রিল সকালে নাশতা সেরে শুরু হলো হাঁটা। হাঁটছি, দেখছি চারপাশ। গাছের আড়াল থেকে আমাদের দেখে নিল হিমালয়ান গ্রিফন (এক জাতের শকুন)। পথে পথে জোঁকের উৎপাত, থামিয়ে দিতে চাইছে বৃষ্টিও। তারপর চলেছি আমরা। সেই সকাল সাড়ে ৭টায় চলা শুরু করেছি। পথ যেন শেষই হতে চাইছে না। একসময় আঁধার ঘনিয়ে এলো। আমরাও চলে এসেছি তরতং। ২৬ এপ্রিল ৯ হাজার ৭৭৭ ফুট উঁচু তরতং পৌঁছে রাত কাটালাম টি-শপে। আমাদের দেশের চায়ের দোকানের মতো নয় এ দেশের টি-শপ। বেশ লম্বা চওড়া জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা দোকানে দু-তিনজন মানুষ অনায়াসে রাত কাটিয়ে দিতে পারে। পরদিন ২৭ এপ্রিল সকালে আবার শুরু হলো হাঁটা। একসময় পৌঁছালাম ১৫ হাজার ১২৫ ফুট উঁচু রামচে। আবহাওয়া বেশ খারাপ। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ছে, তুষারপাতও হচ্ছে। তার পরও যেতেই হবে। চলেছি হিমবাহের ওপরের এবড়ো-থেবড়ো পাথরের বোল্ডারের ওপর দিয়ে। মিডল ক্যাম্প ১৫ হাজার ৭৫০ ফুট উঁচুতে। রাতটা সেখানেই কাটাতে হলো।
যাচ্ছি বেসক্যাম্পে
২৮ এপ্রিল। সকালে নাশতা সেরে চললাম বেসক্যাম্পের পথে। ১৮ হাজার ২০০ ফুট ওপরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল আড়াইটা। দেখা হলো দুই ইরানির সঙ্গে। এই অভিযানে আমার সঙ্গী। আগেই চলে এসেছেন। বেসক্যাম্পে তাঁদের সঙ্গে আছেন দুই শেরপা, এক পাচক আর দুই কিচেন বয়। সবাই মিলে খানিকক্ষণ আড্ডাও দিলাম। পরদিন সকালে নাশতা সেরে অনুশীলন করলাম। পাহাড়ের ২০০ থেকে ৩০০ ফুট ওপরে উঠে আবার নেমে এলাম নিচে।
৩০ এপ্রিল পুরো দিনটাই কেটে গেল বিশ্রামে
শুরু হলো অভিযান
১ জুন শুরু হলো কাঞ্চনজঙ্ঘার পথে সত্যিকারের অভিযান। সকাল সাড়ে ৭টায় যাত্রা শুরু করলাম ২০ হাজার ১৭৭ ফুট ক্যাম্প-১-এর পথে। চলেছি হিমবাহের ওপর দিয়ে, আইস বুট পরে, বরফের কুঠার দিয়ে বরফ কেটে কেটে। পেরিয়ে যাচ্ছি বরফের খাদ, দড়ি বেয়ে উঠছি ওপরে। পৌঁছে যাওয়ার একটু আগে পড়লাম ওভারহ্যাংয়ের কবলে। বরফ এতই কঠিন, ঢুকছে না শক্তিশালী কুঠারও। বহুকষ্টে সে জায়গা পেরোলাম। আমার হেলমেটটা পড়ে গেল হঠাৎ করে। ক্যাম্প-১ পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল।
২ জুন সকাল ৯টায় চললাম ক্যাম্প-২-এর পথে। অনেক কষ্টে পেরিয়ে গেলাম ৩০০ ফুট উঁচু বরফের চড়াই। মাঝেমধ্যে দেয়াল ভেঙে পাথর পড়ছে। সে পথ ঘেঁষে উঠে গেলাম ২১ হাজার ফুট ওপরে। পরদিন আবার নেমে এলাম বেসক্যাম্পে। অলসভাবেই কেটে গেল তিনটি দিন।
৭ জুন রওনা করলাম সামিটের জন্য। সরাসরি চলে এলাম ক্যাম্প-২-এ। সারা দিন কাটিয়ে পরদিন চললাম ক্যাম্প-৩-র পথে। ধীরে ধীরে পেরোচ্ছি ৯০ ডিগ্রি খাড়া দেয়াল, ৩০০-৪০০ ফুট গভীর হিমবাহের খাদ। বিকেলের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ২৩ হাজার ফুট ওপরে। খেয়ে নিলাম খাবারদাবার। ৯ জুনও থাকলাম সেখানে। তিন শেরপা লেগে গেলেন ক্যাম্প-৪-এ ওঠার দড়ি বাঁধতে।
১০ জুন তুষারঝড় আর এবড়ো-থেবড়ো বরফের ওপর দিয়ে উঠলাম ২৪ হাজার ফুট উঁচু ক্যাম্প-৪-এ। তিনজন করে দুই তাঁবুতে রাত কাটালাম। রাত ১১টায় রওনা দিলাম চূড়া জয় অভিযানে। রাতে ঝড়ঝঞ্ঝা কম হয়, আবহাওয়া থাকে শীতল। ফলে বিশ্বের সব পর্বতাভিযানই হয় রাতের বেলা। যাতে সকালে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই ফিরে আসা যায়। সবার মুখে অক্সিজেন, সুযোগ নেই ফিক্স রোপ ব্যবহারের। একজনের পেছনে চলেছি একজন; দড়ি বাঁধা কোমরে। আস্তে আস্তে করে এগিয়ে চলেছি। পা ডুবে যাচ্ছে বরফে। একটু একটু করে উঠে গেলাম হাজার ফুট। তবে ফিরে আসতে হলো ভয়ংকর তুষারঝড়ের কবলে পড়ে। পরদিন রাত ১০টায় আবার চেষ্টা করলাম চূড়া জয়ের। ৬০০ ফুট গিয়ে খারাপ আবহাওয়ায় আবার ফিরে আসতে হলো। মাথাপিছু চার বোতল অক্সিজেনের তিন বোতল শেষ। এক বোতলে কিছুই হবে না। চূড়া জয় করে ফিরতে অন্তত দুই বোতল অক্সিজেন প্রয়োজন। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম বেসক্যাম্পে। খুঁজতে শুরু করলাম কারো কাছে বাড়তি অক্সিজেন আছে? বাড়তি টাকা না থাকায় অক্সিজেন কিনতে পারলাম না। এক বোতল অক্সিজেনের দাম ৭৫০ ডলার। ফলে আমার আর যাওয়া হলো না চূড়া জয় অভিযানে।
চূড়া জয়ের নেশায়
আমাদের কাছ থেকে পুরো অভিজ্ঞতা শুনলেন স্পেনের এক পর্বতারোহী কার্লোস। ভদ্রলোকের বয়স ৭৪ বছর। সব শুনে বললেন, ক্যাম্প-৪ থেকে চূড়ার দূরত্ব ৪১৬৯ ফুট। এই পথটুকু দড়ি না বাঁধলে যাওয়া যাবে না। নানা দল থেকে দড়ি বাঁধার জন্য নির্বাচিত করা হলো পাঁচ শেরপাকে। স্যাটেলাইটে জানা গেল, ১৯ ও ২০ মে আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে ভালো থাকবে। ফলে সেদিন চূড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। শেরপারা জানালেন, বাড়তি দড়ি আছে ক্যাম্প-৩-এ।
১৭ জুন বেসক্যাম্প থেকে ৩৫ জনের দলটি চলে এল ক্যাম্প-২তে। ১৮ জুন ক্যাম্প-৩ হয়ে ১৯ জুন ক্যাম্প-৪। ১৯ জুন কয়েক শ মিটার দড়ি বেঁধে ফেললেন শেরপারা। সবাই মিলে চূড়া জয়ের জন্য রওনা দিলেন সন্ধ্যা ৭টায়। ২৬ হাজার ফুট ওপরে উঠে যাওয়ার পর বাড়তি দড়ি পাওয়া গেল না। অতিরিক্ত দড়ি আছে বেসক্যাম্পে। কিন্তু ফিরে গিয়ে আনা সম্ভব নয়। ২০ জুন সকালে ডেথ জোনে দাঁড়িয়ে কার্লোস বললেন, এখন এগিয়ে যাওয়ার মানে হলো মরণ। টানা দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে তিনিসহ অনেকে নেমে গেলেন। তবে ১৩ জন থেকে গেলেন চূড়া জয়ের নেশায়। মাত্র ১৬৯ ফুট দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে পাগলপারা হয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় সবার আগে চূড়ায় উঠলেন আমার ইরানি এক সঙ্গী রেজা আর মিংমা। একে একে অন্যরাও উঠলেন। ওয়াকিটকিতে এসব খবর জানছি। তবে আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছিল- তাঁরা ভালোভাবে ফিরতে পারবেন তো? পর্বতাভিযানে একটি অপ্তবাক্য আছে দুপুর ২টার পর আর চূড়ার দিকে যেতে হয় না। কারণ তাহলে আর সন্ধ্যার আগে ক্যাম্পে ফিরে আসা যাবে না।
২১ জুন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কেমন যেন সন্দেহ হলো। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি নিস্তব্ধ পরিবেশ। জটলা বেঁধে আলাপ করছে সবাই। কেউ কেউ বাইনোকুলারে কী যেন দেখছে। আস্তে আস্তে খবর আসতে শুরু করল, সেই ১৩ জনের পাঁচজন চিরকালের মতো ঘুমিয়ে রইলেন পর্বতে; মারাত্মক আঘাত নিয়ে আটজন বেঁচে ফিরলেন কোনোমতে।
(অনুলিখন : ওমর শাহেদ)
সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ (০৫/০৭/২০১৩)