কোকিল: ‘করুণ পাপিয়া’
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
‘পিউ পিউ বলে পাপিয়া’- জাতীয় কবি বুঝিবা ওদের ডাকে মুগ্ধ হয়েই ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে গানটি লিখেছিলেন। অন্য অনেক কবি-গীতিকারের কবিতা আর গানে জায়গা করে নিয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর পাখিটি। গ্রামাঞ্চলের ছায়াঘেরা ঘন ঝোপে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ানো পাখিটির নাম করুণ পাপিয়া। ছোট আকারের কোকিল বললেই বরং এক লহমায় চিনে নেওয়া সহজ হয়। ইংরেজি নাম Plaintive Cuckoo, বৈজ্ঞানিক নাম Cacomantis merulinus.
করুণ পাপিয়া ঝোপের আড়ালে গাছের ডালে বসে স্পষ্ট সুমধুর সুরে শিস দেয়। নিজেরা বাসা তৈরি করতে পারে না। এ জন্য এদের সার্বক্ষণিক চেষ্টা থাকে তৈরি বাসায় ক্ষণিকের মাথা গোঁজার। আর কোনো বাসা ক্ষণিকের ফাঁকা পেলেই তাতে ডিম পেড়ে সটকে পড়ে। ফুটকি, প্রিনা, টুনটুনিসহ অন্যান্য পাখির বাসায় ডিম পেড়ে রেখে আসে মেয়ে পাখিটি। আর বাসার মালিক পাখিটি নিজের ডিম ভেবেই তাতে তা দিতে থাকে। একসময় ডিম ফুটে ছানা বের হয়। নিজের ছানা ভেবেই পরম স্নেহ-মমতায় তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। লালন-পালন করতে থাকে। এরপর একসময় তারা বুঝতে পারে যে এটি তার সন্তান নয়। তত দিনে ছানাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিজেরা শিখে যায় খাবার খেতে এবং উড়ে যেতে। আর এভাবেই চলে করুণ পাপিয়ার বংশবিস্তার।
পাখি গবেষক ও আলোকচিত্রী সৌরভ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, “করুণ পাপিয়া আসলে কোকিলই। আমাদের দেশে অনেক প্রকারের কোকিল রয়েছে। কোনোটাকে ‘পাপিয়া’, কোনোটাকে ‘চোখ গেল’, আবার কোনোটাকে ‘বউ কথা কও’ বলে ডাকা হয়। আমাদের দেশে কোকিলের আটটি গণের ১৮টি প্রজাতি রয়েছে। তবে অধিকাংশই পরিযায়ী।”
সৌরভ মাহমুদ আরো বলেন, ‘করুণ পাপিয়া আমাদের দেশে সুলভ আবাসিক পাখি। তবে কোনো কোনো পাঠ্যপুস্তকে পাখিটির নাম ছোট ভরাউ হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। দেশের সব জায়গায়ই কম-বেশি এদের বিচরণ রয়েছে। তবে গ্রামের দিকে একটু বেশি দেখা মেলে। আমি এই প্রজাতির পাখিদের একবার করে সুনামগঞ্জ, বরিশাল ও খুলনায় এবং দুবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেখেছি। এরা সবসময় পাতার আড়ালে-আবডালেই থাকে। সহজে দেখা দিতে চায় না। উপরের ছবিটি আমি গত বছরের এপ্রিলে খুলনার মংলা উপজেলার চাঁদপাই এলাকা থেকে তুলেছি। এটি ছেলে করুণ পাপিয়া।’
পুরুষ করুণ পাপিয়ার পিঠের পালক ধূসর আর বুকের পালক কমলা রঙের। মাথা, ঘাড়ের পাশ ও গলা ছাই-ধূসর। লেজ ধূসর কালো। লেজের আগা সাদা এবং বাইরের পালকে তির্যকভাবে ডোরাকাটা। মেয়ে পাখির চেহারা দুই ধরনের হয়। এক ধরনের চেহারা পুরুষ পাখির মতো। উভয় পাখির চোখ সাদা। পা বাদামি-হলদে। ঠোঁট শিঙ-বাদামি। প্রজনন মৌসুমে ছেলে পাখিটি মিষ্টি সুরে ডাকে। প্রধানত একাই থাকে। তবে মাঝেমধ্যে জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এরা বিশ্বে এবং আমাদের দেশে আজো বিপদমুক্ত অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র থেকে জানা গেছে, পৃথিবীতে Cacomantis গণের আট প্রজাতির পাপিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে করুণ পাপিয়া ছাড়াও আরো দুই প্রজাতির পাপিয়া রয়েছে। এরা হলো মেটেপেট পাপিয়া ও দাগি তামাপাপিয়া। করুণ পাপিয়ার দৈর্ঘ্য ২৩ সেন্টিমিটার, ওজন ২৫ গ্রাম। খাদ্য তালিকায় রয়েছে ছারপোকা, শুয়োপোকা, ফল ইত্যাদি। ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি।
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ৮ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।