ক্যামোফ্লাজঃ প্রকৃতির সাথে ছদ্মবেশ !!!
শাওন চৌধুরী
প্রকৃতিতে রয়েছে লক্ষ-কোটি প্রজাতির সমাহার আর সাথে রয়েছে লক্ষ-কোটি বেঁচে থাকার পদ্ধতি !! প্রতিটি প্রাণিই প্রকৃতির সাথে টিকে থাকতে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে এবং তাদের শারীরিক গঠনেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্রাণি থেকে শুরু করে বৃহৎ মাংসাশী প্রাণি, সবার চলাফেরার ও প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার পদ্ধতি নিজেদের দিক থেকে স্বতন্ত্র আর এই পদ্ধতি এতোটাই স্বতন্ত্র যে এর একটু ব্যত্যয় ঘটলেই যেকোন সময় এরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে। আর এই বেঁচে থাকার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে ক্যামোফ্লেজ বা ছদ্মবেশ।
প্রকৃতিতে যেকোন প্রাণীর কোন বিশেষ উপকারী বৈশিষ্ঠ তার বেঁচে থাকার বা প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে এটি প্রজনন, শিকার ধরা এমনকি প্রজাতির টিকিয়ে রাখাকেও নিয়ন্ত্রণ করে!! তেমনি একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠের নাম হচ্ছে ক্যামোফ্লেজ। প্রকৃতির রঙের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার নামই হচ্ছে ক্যামোফ্লেজ বা ছদ্মবেশ। এই বৈশিষ্ঠের কারণেই অনেক অনেক বছর ধরে ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক থেকে বৃহৎ মাংসাশী প্রাণী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
ক্যামোফ্লেজ বা ছদ্মবেশ ধরে অনেক প্রাণী শিকার ধরে বা অন্যান্য শিকারী প্রাণীর চোখকে ফাকি দিয়ে এড়িয়ে যায়। এমনও কিছু প্রাণী আছে যারা কিনা পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এই বৈশিষ্ঠ অবলম্বন করে। এরা এতো সূক্ষ্মভাবে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যে এদের চারপাশের পরিবেশের থেকে এদের আলাদা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণিরা কিভাবে ক্যামোফ্লেজের মাধ্যমে নিজেদেরকে আত্মগোপন করে রাখে! আমরা কথায় কথায় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠি যে, ‘গিরগিটির মতোন এতো তাড়াতাড়ি রং বদলাস কেন?’ আর এই কথাটি কিন্তু ঐ বিশেষ শব্দ থেকেই এসেছে। ক্যামেলিয়ন এমন এক প্রকার গিরগিটি সদস্য যারা কিনা ক্ষণিকের মধ্যেই নিজের গায়ের রঙ পরিবর্তন করতে পারে এমনকি এদেরকে কি রঙে দেখা যাবে তা অনেকক্ষেত্রে নির্ভর করে এদের মানসিক অবস্থা কিরকম রয়েছে তার ওপরে! এধরণের ক্যামোফ্লেজের কথা বেশীরভাগেরই জানা থাকার কথা যার কারণে অনেকের মনেই অনেক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে গেছে যে যারা শরীরের রঙের পরিবর্তন ঘটায় তারাই কি একমাত্র ক্যামোফ্লেজ ঘটায় নাকি অন্যভাবেও ঘটতে পারে!
মূলত আমার কিছু পরিচিতজনের মধ্যে এমন জটিলতা রয়েছে আর সেটা দূর করার জন্যই আমার আজকের এই লেখা। ক্যামোফ্লেজ বলতে শুধু ওপরের ঐ রকম ঘটনায় যদি হতো তাহলে গিরগিটি সদৃশ প্রাণি ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে কি হতো! আসলে ক্যামোফ্লেজ বলতে প্রকৃতির সাথে নিজের রঙের মিশে যাওয়াকে বোঝায়। যেমন, বাঘের শরীরে ডোরাকাটা দাগ থাকার কারণ। এটা হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা যে শুধুমাত্র বড় বড় ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে শিকার ধরার কারণেই এমন ডোরাকাটা দাগের সৃষ্টি এবং এটাও এক ধরণের ক্যামোফ্লেজ। নীচের ছবিটি দেখলেই আপনাদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
আমরা সকলেই বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ ডারউইনের বিবর্তনবাদের কথা জানি এবং অনেকে মানি আবার অনেক মানিনা, কথা সেইটা না, কথা হচ্ছে এই বিবর্তনবাদের মূলমন্ত্রই হচ্ছে Natural Selection যার কথা কিনা আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস প্রথম বলেছিলেন। যেকোন উপায়ে প্রকৃতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা যার বেশি সে-ই টিকে থাকবে এবং যার কম বা নেই বললেই চলে, পৃথিবী থেকে তার বিলুপ্তি ঘটবে আর এটাই হচ্ছে Natural Selection এর মূলকথা। আর এজন্যই যেই প্রাণি ক্যামোফ্লেজের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারবে, তার বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে কম এবং সে-ই নির্বিঘ্নে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকতে পারবে। সবথেকে মজার কথা হচ্ছে, ক্যামোফ্লেজের সূত্রপাত কিন্তু আজকের কথা না বরং ডাইনোসর যুগ থেকেই প্রকৃতির এই খেলা চলে আসছে যা এখনও বর্তমান।
আজ আপনাদেরকে এমন কিছু উদাহরণ দিব যাতে করে আপনাদের চোখ কপালে উঠে যাবে বলেই মনে করি…..
- Deroplatys trigonoderaনামক প্রজাতির অন্তর্গত এই ম্যান্টিসটি পাতার মধ্যে এমনভাবে থাকে যে হঠাত করে দেখলে এর অস্তিত্বই বোঝা যাবেনা! এমনকি যখন বাতাস বহমান থাকে তখন এরা পাতার সাথে তাল মিলিয়ে নড়াচড়া করে এবং এদেরকে ঐ সময়ে দেখে কেওই আলাদা করতে পারবেননা।
2. নীচের ছবিতে কোন কিছু কি চোখে পড়ছে!!
3. নীচের বামদিকের ছবিটি দেখুন, lantern fly (Fulgora sp.)কি সুন্দর করে গাছের কান্ডের সাথে মিশে গেছে, ডান দিকের ছবিটা হচ্ছে যখন অন্য কোন কিছু যখন এদেরকে দেখেছে এবং এরা বিপদের সংকেত পেয়ে তাকে ভয় দেখাতে চেস্টা করছে।
4. নীচের ছবিতে কি ফুল ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন! এখানে রয়েছে flower mantis (Hymenopus coronatus), ফুলের মধ্যে চুপচাপ লুকিয়ে থেকে শিকারকে সহজে পরাস্ত করতেই এরকম ছদ্মবেশ। এদের চারটি পা দেখতে অনেকটাই ফুলের বৃতির মতোন যার কারনে কোন প্রাণির পক্ষে এদেরকে সনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
5. নীচের ছবিতে green caterpillar (Tanaecia sp.)ক্যামোফ্লেজের মাধ্যমে নিজেকে অনেক সুন্দর করে আড়াল করে রেখেছে।
6. অনেক প্রাণিই খাবার হিসেবে পাতা অনেক পছন্দ করে তারপরও প্রকৃতির কাছে নিজেকে আড়াল করতে dead leaf butterfly(Kallima sp.)এর এরকম আচরণ।
7. নীচের ছবিতে লাইকেনের মতোন দেখতে এরা হচ্ছে Katydid, নিজেদেরকে লাইকেনের মতোন করে ঢেকে রাখতে এরা ঐ অংশের লাইকেন খেয়েও ফেলে!
8. Walking stick insects (Lonchodes sp.) এরা গাছের ডালের মাঝে নিজেদেরকে ডালের মতোন করে রাখতে দুটো ডালের মাঝবরাবর এমনভাবে বসে থাকে যেন দেখে মনেহয় ডালের আরেকটি শাখা বের হয়েছে!
লেখকঃ বিভাগীয় সম্পাদক (প্রাণিজগত) , বিজ্ঞান ম্যাগাজিন- জিরো টু ইনফিনিটি