গবেষণা : আশার পর বনি ও চৈতি

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

আশার পথ ধরেই অগ্রসর হলো বনি ও চৈতি। ওরা এখন দিব্বি সুস্থ, স্বাভাবিক। কেউ ওদের বিরক্ত করছে না। নিজেদের মতো করে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকৃতির মাঝে। কখনো জলাশয়, কখনো ঘন জঙ্গল, কখনো বা মাটির গর্ত। তবে ওরা স্বাধীন, মুক্ত। কেবল সারাক্ষণ ওদের দেহে সেঁটে আছে ছোট্ট একটি যন্ত্র। বাংলাদেশে প্রায় আট মাস আগে প্রথম রেডিও ট্রান্সমিটার বসানো হয় আট ফুট দৈর্ঘ্যরে স্ত্রী প্রজাতির অজগর আশার শরীরে। গত বছরের ১৮ জুলাই আশাকে অবমুক্ত করা হয় মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গহিন অরণ্যে। এর মধ্য দিয়ে এ দেশে বন্য প্রাণী গবেষণার একটি ঐতিহাসিক শুভ সূচনা ঘটে। আশার এই সফলতার পর বনি ও চৈতি নামের দুটি অজগরের শরীরেও স্থাপন করা হয়েছে একই ধরনের রেডিও ট্রান্সমিটার।

স্বনামধন্য সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ ও অজগর গবেষণা প্রকল্পের প্রধান শাহরীয়ার সিজার রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আশার পর আমরা বনি ও চৈতিকে লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত করেছি। বনির দৈর্ঘ্য আট ফুট আর চৈতির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ ফুট। গত বছরের ১১ অক্টোবর তাদের দেহে অস্ত্রোপচার করে রেডিও ট্রান্সমিটার বসানো হয়। তিন দিন পর্যবেক্ষণ শেষে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় লাউয়াছড়ার অরণ্যে।’ তিনি বলেন, ‘সবার আগে অবমুক্ত করা আশা যে শিকার ধরে খাচ্ছে এটার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ট্রান্সমিটার স্থাপনের পর গত ছয় মাসে সে তিনবার নিজের খোলস পাল্টিয়েছে। সে সুস্থ, স্বাভাবিক এবং ভালো আছে। ভালো আছে বনি ও চৈতি।’Sreemangal Report_Radio Transmeter_1 (Bonnie)

শাহরীয়ার সিজার বলেন, ‘অবমুক্ত করা তিনটি অজগর থেকে মজার মজার তথ্য মিলছে। আগে ধারণা করা হতো যে শীতকালে অজগর শীতনিদ্রায় চলে যায়। কিন্তু ওরা এত দীর্ঘ সময় গর্তে থাকে না। শীতের শুরুতেও ওরা পানিতে থাকে। পানির তাপমাত্রা বাতাসের তাপমাত্রার মতো ঘন ঘন ওঠানামা করে না এবং পানির ভেতরের তাপমাত্রা বাতাসের তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে। এ জন্য ওরা সরাসরি পানিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে আশা ও চৈতি এত দিন পানিতেই ছিল। কিন্তু এখন এরা পানি থেকে উঠে গর্তে ঢুকে গেছে এবং বনি এখনো পানিতেই রয়েছে।’

শাহরীয়ার আরো বলেন, মজার ব্যাপার হলো- এই তিনটি অজগর সংগ্রহ করা হয়েছিল গ্রামের আশপাশ থেকে। যন্ত্র স্থাপন করে গভীর বনে ছাড়ার পর দেখা গেল ওরা পুনরায় ওই সব গ্রামের আশপাশে চলে গেছে। কারণটা হলো, ওদের নিজস্ব একটা ‘হোম রেঞ্জ’ থাকে। তা থেকে সরিয়ে দিলেও ওরা ফিরে যায়। আর মানুষের আশপাশে থাকলেও মানুষ সহসা ওদের দেখতে পায় না। কারণ কারো উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র ওরা নিজেদের ঝটপট আড়াল করে ফেলে।

প্রকল্পের জনসংযোগ সমন্বয়কারী রূপা দত্ত বলেন, ‘বন্যপ্রাণী গবেষণা সংগঠন ক্যারিনাম, বন মন্ত্রণালয় ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সহায়তায় এই গবেষণা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় সরীসৃপ অজগরকে প্রকৃতির মাঝে বাঁচিয়ে রাখা এবং এদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহই এ গবেষণা অন্যতম উদ্দেশ্য।’

ক্যারিনামের প্রধান নির্বাহী ও এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক ড. এস এম এ রশিদ বলেন, ‘অজগর সম্পর্কে তো আমাদের আগ্রহ অনেক। কিন্তু এর মৌলিক তথ্যগুলোই আমাদের কাছে নেই। চলমান গবেষণার মধ্য দিয়ে এদের গতিবিধি ও বিচরণস্থলসহ নানা তথ্য আমরা পেয়ে যাব। তথ্যগুলো সংগ্রহের পর বন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিলুপ্তপ্রায় অজগর প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে করণীয় পরিকল্পনা করব।’

ড. রশিদ আরো বলেন, “অজগরের বায়োলজিক্যাল তথ্যগুলো সংগ্রহ করার জন্য ওর শরীরে ‘রেডিও ট্রান্সমিটার’ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘আই-বাটম’ নামের আরেকটি যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা ওর গায়ের তাপমাত্রাও মাপতে সক্ষম হব। আমরা সাপটির গায়ে যে ট্রান্সমিটার স্থাপন করেছি ওই ট্রান্সমিটারের ব্যাটারি ক্ষমতা থাকবে দুই বছর পর্যন্ত। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সাপটিকে খুঁজে বের করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ট্রান্সমিটারটি বের করে পুনরায় তাকে বনে ছেড়ে দেওয়া হবে। ’

রেডিও ট্রান্সমিটার সম্পর্কে গবেষক শাহরীয়ার বলেন, ‘আধঘণ্টার একটি ছোট্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অজগরের চামড়া নিচে মাত্র ২০ গ্রাম ওজনের ক্ষুদ্র যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়। এটি দেখতে অনেকটা পেন্সিল ব্যাটারির মতো। ৫০০ মিটার থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত এই ট্রান্সমিটারের কার্যক্ষমতা। ট্রান্সমিটারটি বসিয়ে অজগরটিকে ছাড়ার পর তাকে বার বার অনুসরণ করতে হয়। আমাদের হাতে থাকা রেডিওতে ‘বিপ’ ‘বিপ’ ‘বিপ’ সংকেতধ্বনি জানান দেবে ওর উপস্থিতি।’

সূত্র: ৫ মার্চ ২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক,

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ

স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট

বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর.কম

biswajit.bapan@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics