জমজমাট হাট-বাজার,তবে জলের উপর!!
ফারজানা হালিম নির্জন
স্বচক্ষে না দেখলেও ইতালীর ভেনিস নগরীর গল্প নিশ্চয়ই অনেক শুনেছেন? কেউ কেউ হয়তো ভ্রমন করে,সেই দুর্লভ অনুভূতির সাক্ষীও হয়ে গেছেন। মুগ্ধতার আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতোই তো একটি শহর! ‘ভাসমান শহর’ কিংবা ‘দ্যা সিটি অব ব্রীজস ’ অথবা ‘দ্যা সিটি অব ওয়াটার’ও যাকে মাঝে মাঝে আদর করে ডাকা হয়ে থাকে । ইতালীর ভেনিসের পাশাপাশি অনেকে নিশ্চয়ই কাশ্মীরের ‘ডাল লেক’ এর কথাও শুনে থাকবেন,যা কিনা ভাসমান বাজারের জন্য পৃথিবীখ্যাত। কিংবা থাইল্যান্ডের মনোমুগ্ধকর সেই ভাসমান বাজারগুলো ?মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। যারা এখনো বুঝতে পারছেন না,এবার তাহলে তাদের জন্য একটি খবর দেই। ভাসমান বাজার দেখার জন্য আপনাকে কষ্ট করে অতদূর যেতে হবে না। রত্নের ভান্ডার;আমাদের বাংলাদেশেই এমন অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখার সুযোগ মিলবে।
বর্ষা মৌসুমে,দক্ষিনের জেলা ঝালকাঠির বিভিন্ন জায়গায় বসে ভাসমান হাট। এখানে বেঁচাকেনা হয় বিভিন্ন মৌসুমি ফল,সবজি থেকে শুরু করে খোদ নৌকা পর্যন্ত ! জেলেরা নয়,বরং এসব ফল-মূল,সবজি বিক্রির আশায় নৌকায় ঘুরে ঘুরে দিন কাটায় চাষীরা। তবে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট যাকে বলা হয়,ঝালকাঠি জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সেই ভিমরুলী গ্রামের খালের মোহনায় পেয়ারা বোঝাই ভাসমান নৌকা গুলোকে দেখলে ইতালীর ভেনিস যাওয়ার অতৃপ্তি অনেকটাই ঘুচে যাবে বৈকি! শত হোক,নিজের দেশ,নিজের মানুষ,সবকিছুই নিজের বলে কথা !
ভিমরুলী ভাসমান বাজারটি প্রকৃত অর্থে খালের একটি মোহনায় বসে। তিন দিক থেকে তিনটি খাল এসে মোহনা তৈরী করেছে যেখানে, অপেক্ষাকৃত সেই প্রশস্ত স্থানেই পেয়ারা বোঝাই নৌকা নিয়ে ক্রেতা খুঁজে বেড়ান চাষীরা। ভিমরুলী গ্রামের এই পেয়ারা হাট বসে সপ্তাহের প্রত্যেকদিনেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বিকিকিনি। আর ক্রেতা বলতে মূলত পাইকাররা। বড় বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে তারা আসেন,আর সব ছোট ছোট নৌকা একেবারে খালি করে রেখে যান। বেঁচাকেনার সবচেয়ে জমজমাট সময় কাটে দুপুর ১২ টা থেকে ৩ টে পর্যন্ত। তখন নৌকার সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এতো পেয়ারা আসে কোত্থেকে ? খুব সহজ,খালের আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা কেবল পেয়ারার বাগানেই ভরপুর। চাষীরা এসব বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে সরাসরি হাটে উপস্থিত হন। এই অঞ্চলে আমড়ার ফলনও প্রচুর পরিমাণে হয়। পেয়ারার হাট শেষ হলে শুরু হয়,আমড়ার হাট। এছাড়াও লোক সমাগম একটু কম হলেও,বছরের অন্যান্য সময়ও হাট চলতেই থাকে। তখন বাজারের প্রধান পণ্য থাকে বিভিন্ন জাতের সবজি। ভিমরুলীর এই ভাসমান হাটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো,এখানে আসা প্রায় সবগুলো নৌকার আকার ও নকশা প্রায় একইরকম। বাজারের উত্তরপ্রান্তে খালের উপর ছোট্ট একটি সেতু আছে,সেখান থেকে খুব চমৎকারভাবে পুরো হাটটির উপর চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়। স্বয়ং উপস্থিত না থেকেও,কল্পনায় এখন সেই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে একটু ভেবেই নিতে পারেন ,ঠিক সন্ধ্যা মেলাবার সময় হারিকেনের ঢিমে আলোয় পানিতে শত শত নৌকা দুলছে। দৃশ্যটি কেমন হবে ?
ভিমরুলীর পর ঝালকাঠিতে আরো একটি বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারার হাট আছে। আটঘর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে,আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারার হাট বলেই খ্যাত। এ বাজারটিতে চাষীরা পৌঁছবার আগেই তাঁদের জন্য পাইকাররা অপেক্ষা করে থাকেন। পৌঁছানো মাত্রই বিক্রি হয়ে হয়ে যায় সব পন্য,চোখের পলকে।
হাটের হাঁড়ি তো ভাঙ্গা হলো,সৌন্দর্যের রুপ-নকশাও আঁকা হলো অনেক। হাটের গল্পের মাঝে এখন তবে একটু হাহাকারের গল্প শুনি। যে গল্পের নায়ক,সেই নৌকার মাঝিরা। পিরোজপুর,ঝালকাঠি,বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা সড়ক পথে নেয়ার কোনো ব্যাবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। পেয়ারার এতো বাম্পার ফলন হয় এখানে,অথচ হিমাগারের অভাবে তা সংরক্ষণেরও কোনো ব্যাবস্থা নেই। যে কারণে অল্প-আয়ের এইসব চাষীদের একমাত্র আশা হলো পাইকারদের পথপানে চেয়ে থাকা। বড় বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে পাইকাররা এসব ভাসমান হাটে যান,আর নৌ পথেই তা চালান করে দেন ঢাকা সহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে। এবার চোখ ফেরানো যাক পেয়ারার বিক্রয়মূল্যের দিকে। ভাগ্য ভাল থাকলে মৌসুমের শুরুতে ১৫-২০ টাকা কেজি দরে পেয়ারা বিক্রি করতে পারলেও কখনো কখনো তা ১ টাকাতে এসেও পৌঁছায়! চাষীদের সাথে শ্রমিকরাও থাকেন,যারা পেয়ারা সংগ্রহ করতে সহায়তা করেন। এতো কম টাকায় শ্রমিকদের চাহিদা মেটানোও চাষীদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ভিমরুলীর এই হাট থেকেই নৌ পথে করে ঢাকা,চট্টগ্রাম,সিলেট,পটুয়াখালী,খুলনা,ফেনী,ভোলা,নাটোর,বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়কপথের যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জায়গায় পেয়ারা নেয়ার জন্য পাইকাররা চাষীদের কাছ থেকে আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনতেন। হয়তোবা অনেকক্ষেত্রে চাষীরা,নিজেরাও পাইকারের জায়গা দখল করে সুলভ এবং ন্যায্য মূল্যে বড় বড় জেলা শহরে তা বিক্রি করে তাঁদের ভাগ্য বদলে দিতে পারতেন !
দিন বদলাবে,এমন আশা বুকে লালন করে আমরাও তো এখন ঘুরে আসতে পারি ঝালকাঠির সেইসব ভাসমান হাটগুলো থেকে! দেখে আসতে পারি চাষীদের জীবন-যাত্রা। জলের দেশ,বাংলাদেশে যে এতো সুন্দর ভাসমান হাট বসে,তা দেখার লোভ সংবরণ করা নিশ্চয়ই উচিত হবেনা ! চাষীদের জীবন-যাত্রার মান উঁচু হবে আর সেই সাথে উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও সুপরিচিত হবে ঝালকাঠি জেলার ভিমরুলী ভাসমান হাট,এমনটা আশা করা কি খুব বেশি অপরাধ ?