জালের ফাঁদে বাইক্কা বিলঃ অবরুদ্ধ পাখি ও মাছ

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

বাইক্কা বিল- দেশে স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রমের অন্যতম একটি। অথচ জাল স্থাপন, সেচযন্ত্রের ব্যবহার ও শব্দদূষণের ফলে এই বিলের মৎস্য সম্পদসহ নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আজ হুমকির মুখে। প্রভাবশালীরা বিলের লিজকৃত জলাভূমি থেকে আরো বেশি পরিমাণ জায়গা দখল করে জাল দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জাল দিয়ে নিজ এলাকা চিহ্নিত করতে গিয়ে বিলের মাছগুলো আটকে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ সেচযন্ত্র লাগিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরছে। মানা হচ্ছে না সরকারি জলমহাল বন্দোবস্ত প্রদানের শর্তাবলি।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আবকান পাহাড়ের এক প্রান্তে বিশাল ভূমিকম্পের প্রভাবে হাইল হাওরের সৃষ্টি। ১৩০টি বিল এবং বেশ কয়টি খাল নিয়ে গঠিত এই হাইল হাওরটিকে একসময় বলা হতো বৃহত্তর সিলেটের মৎস্যভাণ্ডার। বর্তমানে ১২৯টি সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় বিল নিয়ে হাওরটি ১৫ হাজার হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। তবে শুকনো মৌসুমে চার হাজার হেক্টরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। চা বাগান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে একসময় ৩৫২টি পাহাড়ি ছড়া হাইল হাইরে গিয়ে পড়ত। এগুলোই ছিল হাওরের একমাত্র পানির উৎস। মাটি খুঁড়ে বালু উত্তোলনসহ পরিবেশ ধ্বংসের নানা অপঘাতে এগুলোর বেশির ভাগই অস্তিত্ব হারিয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৫৮টি পাহাড়ি ছড়া জীবিত রয়েছে।Srimangal Pic-1

হাইল হাওরে অবস্থিত ১০০ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট বাইক্কা বিলকে ২০০৩ সালের ১ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তোলার ফলে অনেক বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ এখানে বংশ বৃদ্ধি করে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। হাওর এলাকার প্রায় ৬০টি গ্রামে দুই লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে, যাদের ৮০ শতাংশেরই পেশা মাছ ধরা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাখি এলাকা হিসেবে তালিকাভুক্ত এই বাইক্কা বিল। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও পাখি গবেষণাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে এখানে প্রতিবছর জলচর পাখি শুমারি হয়ে থাকে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বাইক্কা বিলের প্রবেশমুখের ডানদিকে ‘ইন্টারপিটিশন সেন্টার’ সংলগ্ন অবৈধভাবে ৮-১০টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। নৌকা নিয়ে বাইক্কা বিলের পশ্চিম পাশের কুলিমারা বিলে গিয়ে দেখা গেল বিশাল এলাকা জালের ঘেরে বন্দি। চার-পাঁচজন মানুষ এখানে কাজ করছে। তাদের দুজন আব্বাস আলী ও আয়াত আলী বলেন, ‘এটি পিয়ার আলীর জলমহাল।’ বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠনের (আরএমও) সাবেক সভাপতি পিয়ার আলী অবৈধভাবে জালের বেড়া দিয়ে বিলটি আটকে রেখেছেন। ফলে মাছ উন্মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারছে না।Srimangal Pic-4

বাইক্কা বিলের উত্তর পাশে ‘কুরাইয়া ডোবা’ও জাল দিয়ে ঘেরা হয়েছে। বিলের উত্তর-পশ্চিম অংশটিও বাঁশের পাটির বেড়ায় অবরুদ্ধ। এই দুই জলমহাল রয়েছে সনোর উদ্দিনের দখলে।মহিয়া বিলসহ আরো কয়েকটি বিলে পাম্প লাগিয়ে জলসেচ করেও মাছ ধরা হচ্ছে। উন্মুক্ত বিল থেকে এভাবে পানি সেচের ফলে বিলগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। সেচযন্ত্রের প্রচণ্ড শব্দে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখিগুলো বিলের পানিতে বসতে পারছে না। আকাশে উড়াউড়ি করছে। পরিবেশ দূষণের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিলের অতিথি পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসীর অভিযোগ, পিয়ার আলী ও সোনর উদ্দিন বিলের খাস জলাভূমি দখল করে মাছ ধরছেন।

বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠনের (আরএমও) সভাপতি আবদুস সোবহান চৌধুরী ও সদস্য মিন্নত আলী বলেন, বাইক্কা বিলসংলগ্ন ‘১০ নম্বর দাগ’ নামক বিলটি বাইক্কা বিলের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বর্ষা মৌসুমে মাছ এখানে অবাধে বিচরণ করতে পারত। এ ছাড়া বিলের দক্ষিণে অবস্থিত ‘বিয়াই বিল’-এর লিজ বাতিলও জরুরি। কারণ এটি যারা লিজ নেয় তারা প্রত্যেকেই বাঁধ দিয়ে সেচযন্ত্র লাগিয়ে মাছ শিকার ধরে। ফলে একসময় বাইক্কা বিল শুকিয়ে যায়।

দেশবরেণ্য পাখি বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ইনাম আল হক বলেন, ‘প্রতিবছর শীত মৌসুমে এই বাইক্কা বিল পরিযায়ী পাখিদের একটি উৎকৃষ্ট মিলনমেলায় পরিণত হয়। এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাসের আওতায় প্রতিবছর এই বিলে পাখি শুমারি হয়। অথচ বাইক্কা বিল বা এর আশপাশে অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকার করে মূল্যবান জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। এটি দ্রুত বন্ধ করা দরকার।’

মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলমহালে জাল ফেলে রেখে মাছের বিচরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কিংবা সেচযন্ত্র দিয়ে বিল শুকিয়ে ফেলার মতো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন অবস্থানে রয়েছি। কিছুদিন আগেও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সেচযন্ত্রসহ একজনকে আটক করা হয়েছে। এ রকম কিছুর প্রমাণ পাওয়া গেছে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনঃ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি।

স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট

www.banglanews24.com

biswajit.bapan@gmail.com

 সূত্র: ১৮ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন।

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics