ঝুঁটিওয়ালা ‘পাতি হুদহুদ’
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
মাথায় বাহারি ঝুঁটি। প্রজনন মৌসুমে অথবা রেগে গেলে ফুটন্ত ফুলের মতো ঝুঁটি মেলে ধরে। তখন দূর থেকে মনে হয় মাথার ওপর ফুল ফুটে আছে। লম্বা ঠোঁট। গোসল করার পদ্ধতিতেও রয়েছে ব্যতিক্রম। সাধারণত এরা পানিতেই গোসল সেরে নেয়। তবে নির্জন জমাটবদ্ধ পানির উৎস খুঁজে না পেলে জনহীন রাস্তার বালিই হয়ে ওঠে গোসলের জলাশয়। ধুলোবালি গায়ে ছড়িয়ে দলগতভাবে গোসলের কাজটি দ্রুতই সেরে নেয়। মাঝারি আকারের অপূর্ব সুন্দর পাখিটির নাম ‘পাতি হুদহুদ’ তবে মোহনচূড়া, হুপো ইত্যাদি আঞ্চলিক নামেও ডাকা হয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও এ পাখির নাম উল্লেখ রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীতেও এ পাখির বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। এর ইংরেজি নাম Common Hoopoe বা Eurasian Hoopoe এবং বৈজ্ঞানিক নাম Upupa epops।
পাখি গবেষক ও লেখক সীমান্ত দীপু কালের কণ্ঠকে জানান, পাতি হুদহুদ দুর্লভ আবাসিক পাখি। দেখতে কিছুটা কাঠঠোকরা পাখির মতো হলেও এরা এক পরিবারের নয়। পৃথিবীতে ‘হুদহুদ’ বা Upupidae পরিবারের পাখি দুই প্রজাতিরই রয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় এ পাখির দেখা পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশে একটি প্রজাতিকে বিচরণ করতে দেখা যায়। এটা স্থানীয় প্রজাতির পাখি। দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে দলগতভাবে বিচরণ করে।
১০ থেকে ২০টি পাখি একত্রে বিচ্ছিন্ন একটি দল গঠন করে খাদ্যের সন্ধানে অথবা বাসা বানানোর জন্য স্থান বদল করে থাকে।
আকার-আকৃতি : হুদহুদ পাখি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩১ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৬৫ গ্রাম হয়ে থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা একই ধরনের। মুখ, গলা ও বুক কমলা-পীতাভ বা লালচে-কমলা। ডানায় সাদা ও কালো রঙের ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। মাথার ঝুঁটির রং কমলা। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি ঝুঁটি ফুলের মতো মেলে ধরে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।
খাদ্য : পাতি হুদহুদ পাখির ঠোঁট অন্যান্য পাখির চেয়ে অপেক্ষাকৃত লম্বা ও কাস্তের মতো কিছুটা বাঁকা। ঠোঁটের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৭ সেন্টিমিটার। নরম মাটির মধ্যে ঠোঁট গুঁজে খাদ্য খুঁজে বেড়ায়। শুঁয়োপোকা, কেঁচো, ফড়িং, উঁইপোকা, ঝিঁঝি পোকাসহ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় খায়।
প্রজনন : বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পাখিটি নির্জন নদীর পাড়, আবাদি ও পতিত জমি, খোলা শুকনো মাঠ প্রভৃতি স্থানে একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। এপ্রিল থেকে জুন এদের প্রজনন মাস। একেকটি পাখি তখন পাঁচ থেকে সাতটি ডিম দেয়। ডিমগুলোর রং নীল। মেয়ে পাখির চেয়ে পুরুষ পাখি অধিক সময় ডিমে তা দেয়। ১৫ থেকে ১৭ দিন পর ডিম থেকে ছানা বের হয়।
আবাস : বাংলাদেশে পাতি হুদহুদ পাখির সংখ্যা দ্রুতই কমে যাচ্ছে। খাদ্য সংগ্রহ ও বাসা তৈরির সমস্যার জন্য এদের অবস্থান আগের মতো নেই। সাধারণত এরা পুরনো গাছের গর্ত, পুরনো দালানকোঠার ফাটল, সুড়ঙ্গ প্রভৃতি স্থানে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে। ওই সব জায়গার সংকট দেখা দেওয়ায় পাখিটির প্রজননও বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে।
লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ২২ অক্টোবর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন