ডিএনএ রহস্যের পেছনের রহস্য
সাবেরা সায়মা
পরিবারে কোন নতুন সন্তান আগমনের পরপরই পরিবারের সব সদস্যদের উৎসাহ থাকে,সে দেখতে কার মতো হয়েছে তা নিয়ে। চোখ দুটো মায়ের মতো টানাটানা,নাকটা হয়তো বাবার মতো বোঁচা, এসব নিয়েই থাকে সবার জল্পনা কল্পনা। মা-বাবা থেকে সন্তানের মধ্যে এসব বাহ্যিক এমনকি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বাহক হচ্ছে ডিএনএ (ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক এসিড)।
বংশগতির ধারক ও বাহক ডিএনএ এর গাঠনিক রহস্য উদ্ঘাটনকারী ,নোবেল বিজয়ী জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক এর মতে ডিএনএ দেখতে প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো। অসমান্তরাল দুটি প্যাঁচের বাইরের দিকে কাঠামো দেয়া ডিঅক্সি রাইবোজ সুগার এবং ফসফেট গ্রুপ এর অবস্থান। ভেতরের দিকে একটার পর একটা সিঁড়ির ধাপের মতো এডেনিন বেস থাইমিন বেসের সাথে আর গুয়ানিন বেস সাইটোসিন বেসের সাথে হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে যুক্ত। ডিএনএর এই গঠন দাঁড় করাতে ওয়াটসন ও ক্রিককে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল এবং সেটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। স্বনামধন্য ব্যাপক অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের তিনটি দল সে সময় ডিএনএ গঠনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করছিল। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে থাকা মলিকিউলার বায়োলজি সম্পর্কে খুবই অনভিজ্ঞ দুজন যুবক, প্রাণিবিদ্যায় বিএসসি এবং পিএইচডি করা জেমস ওয়াটসন ও পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করা ফ্রান্সিস ক্রিক। ক্রিকের অবশ্য রসায়ন সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা ছিল। নোবেল বিজয় তো দূরে থাক,ডিএনএ রহস্যের উদ্ঘাটনকারী হিসেবে তাদের কেউ হয়ত কল্পনায়ও ভাবেননি।
১৯৫১ সালে,খুব স্বল্প জ্ঞান নিয়ে আর অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই ওয়াটসন ও ক্রিক সাহেব ডিএনএ সম্পর্কে তাদের প্রথম মডেলটি উপস্থাপন করেন। সেই সেমিনার এ উপস্থিত ছিলেন মরিস উইলকিন্স,রোজালিন্ড ফ্রাংক্লিন সহ লন্ডন কিংস কলেজের আরও দুজন বিজ্ঞানী। ওয়াটসন ক্রিক শাখাপ্রশাখা সহ গাছের মতো অদ্ভুত এক মডেল উপস্থাপন করেন যার ভেতরের দিকে ছিল সুগার ফসফেট এবং তার সাথে লাগানো বাইরের দিকে থাকা নাইট্রোজেন বেস। তাদের উপস্থাপিত এ মডেলটি নানা জনের নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হয়। তাদের মধ্যে ফ্রাংক্লিন ছিলেন অন্যতম। তিনি ডিএনএ হেলিকাল (প্যাঁচানো) ও ফসফেট গ্রুপের বাইরে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভুলে ভরা এই মডেল উপস্থাপনের পর ওয়াটসন ও ক্রিক এর সুপারভাইজর প্রফেসর ব্র্যাগ এতটাই হতাশ ও লজ্জিত হলেন যে তিনি তাদের ডিএনএ নিয়ে আর কাজ না করার অনুরোধ করেন।
এতোসব সমালোচনার মুখে থেমে যাওয়ার পাত্র তারা ছিলেন না। বরং আরো নতুন উদ্যোম নিয়ে তারা কাজ করতে শুরু করলেন। তবে তাদের কাজের ধরনটা পাল্টে গেল, গোয়েন্দাদের মতো তারা এখানে সেখানে ছুটে বেড়ালেন নতুন সূত্রের সন্ধানে, জোগাড় করতে শুরু করলেন সে সময়ের গণ্যমান্য বিজ্ঞানীদের ডিএনএ নিয়ে গবেষণার ডাটা।
সেসময় রোজালিন্ড ফ্রাংক্লিন ছিলেন এক্স-রে এর মাধ্যমে ডিএনএ নিয়ে গবেষণার পথিকৃত। ওয়াটসন তার কাছে গিয়ে ও হাজির হলেন,হেলিকাল থিওরির মাধ্যমে জোড় দাবি করলেন ডিএনএ অবশ্যই হেলিকাল (প্যাঁচানো)। পূর্বের মতো ফ্রাংক্লিন আবারও ওয়াটসন এর বিরোধিতা করলেন যে, ডিএনএ হেলিকাল হবার পক্ষে কোন পোক্ত প্রমান নেই। তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে ফ্রাংক্লিন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন যে, মার খাওয়ার ভয়ে ওয়াটসন সেখান থেকে সটকে পরেন। নিরাশ মনে ফ্রাংক্লিন এর ল্যাব থেকে বের হয়ে আসার সময়,দেবদূতের মতো তার সামনে এসে হাজির হোন উইলকিন্স। ওয়াটসনের অনেক কাকুতি মিনতির পর, ফ্রাংক্লিনকে না জানিয়েই,উইলকিন্স ডিএনএ এক্স-রে রিপোর্টটির এক ঝলক দেখতে দেন তাকে। ট্রেনে করে বাড়ি ফেরার পথে সেই ডিএনএ এক্স-রে রিপোর্টএর একটা স্কেচ তৈরী করে ফেলেন ওয়াটসন।
আবার নতুন উদ্যমে কাজ করতে শুরু করলেন দুজন। প্রায় বছরখানেক আগে তাদের সাথে কেম্ব্রিজে এক খ্যাতনামা বায়োকেমিস্ট চারগফের দেখা হয়। ওয়াটসন ও ক্রিক চারগফের দেয়া তথ্যগুলোকে ডিএনএ গঠনের রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে লাগানো শুরু করলেন। তাদের সেই স্মৃতি ও খুব একটা সুখকর ছিলনা।ডিএনএতে নাইট্রোজেন বেস এডেনিন এর সমান সংখ্যক থাইমিন বেস আর গুয়ানিন এর সমান সংখ্যক সাইটোসিন বেস থাকে,চারগফের এই বিখ্যাত সূত্র ও তাদের জানা ছিলনা।চারগফকে অবাক করে দিয়ে ক্রিক নিজেই স্বী্কার করেন যে,ডিএনএর চারটি নাইট্রোজেন বেস এর গঠন ও তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা।
“BETTER LATE THAN NEVER’’- দেরিতে হলেও চারগফের তথ্যগুলো ডিএনএ গঠনের রহস্যের কূল কিনারা পেতে বেশ সাহায্যই করেছিল তাদের।ফ্রাংক্লিন এর ডিএনএ এক্স-রে রিপোর্টটি থেকে তারা ধারনা পান যে,নাইট্রোজেন বেসগুলোকে সুগার ফসফেট কাঠামোর ২০ এংসট্রমের মাঝে স্থাপন করতে হবে।বড় আকারের পিউরিন নাইট্রোজেন বেস এডেনিন অথবা গুয়ানিন এর সাথে ছোট আকারের পাইরিমিডিন নাইট্রোজেন বেস থাইমিন অথবা সাইটোসিনকে হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে যুক্ত করে দিলে তা ২০ এংসট্রম জায়গার মাঝে খুব সুন্দর ভাবে সেঁটে যায়। ডিএনএ এক্স-রে রিপোর্ট আর নানা হিসাব নিকাশের মাধ্যমে তারা আরো জানতে পারেন যে, দুটি প্যাঁচের প্রতিটি ঘূর্ণণে বেস এর সংখ্যা দশ। ট্রিপল হেলিক্স মডেলে তার সমন্বয় করা সম্ভবপর ছিলোনা। তাই ডিএনএ এর ট্রিপল হেলিক্স এর ধারনাও তারা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন।
কার্ডবোর্ড এর টুকরো নিয়ে অনেকটা বাচ্চাদের মতো খেলার ছলেই ডিএনএ এর গঠন দাড় করে ফেলেন ওয়াটসন ও ক্রিক । ১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল জার্নালে প্রকাশিত হয় ৯০০ শব্দের একটি আর্টিকেল। আর তার লেখক ছিলেন অখ্যাত দুইজন ব্যাক্তি জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ।
এর পরের গল্পটা আমাদের সবার জানা। দুজন ছন্নছাড়া যুবকের জিরো থেকে রীতিমত হিরো বনে যাওয়া।তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে নোবেল বিজয়ীদের খাতায় নাম লিখিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজও দুটি স্বরণীয় নাম,জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক।