দেখা মিলল সিঁদুরে হলুদ মৌটুসির

2013-04-09-19-47-29-516470511f3a3-untitled-11
ঢাকার রমনা পার্কে দুর্লভ পুরুষ সিঁদুরে হলুদ মৌটুসি। ২০১২ সালের অক্টোবরে ছবিটি তুলেছেন দেলোয়ার হোসেন

আ ন ম আমিনুর রহমান

গত ২৩ মার্চ দুপুরে রমনা উদ্যানে নীলটুনি-মৌটুসিদের খোঁজ নিতে গেলাম। এখন এদের প্রজননকাল। কাজেই পুরুষ নীলটোনার গায়ে খেলবে বাহারি রঙের মেলা। ঢুকেই নির্দিষ্ট গাছে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলাম। প্রথমে পেলাম মৌটুসি, এরপর নীলটোনা। তন্ময় হয়ে নীলটোনার রং-রূপ ও ‘হোভারিং’ দেখছিলাম। সংবিৎ ফিরল আমার মতোই পাখি দেখতে আসা পরিচিত ব্যক্তিদের ডাকে। তাঁদের একজন বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা শংকর সাঁওজাল, অন্যজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক মো. দেলোয়ার হোসেন। দুজনেই বেশ ভালো ছবি তোলেন। কুশল বিনিময়ের পর আমরা একসঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক হাঁটলাম, গল্প করলাম এবং পাখির ছবি তুললাম। শংকরদা নীলটোনা ও পুরুষ মৌটুসির ‘হোভারিং’-এর অসাধারণ দুটো ছবি তুললেন।
আমরা বেশ সময় ধরে নীলটোনার ‘হোভারিং’ দেখছিলাম এবং গল্প করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে দেলোয়ার বললেন, অক্টোবর ২০১২-এ তিনি যখন রমনায় নীলটোনার ছবি তুলছিলেন, ঠিক তখন নীলটোনার প্রায় ওপর দিয়ে একটি লাল রঙের লম্বালেজি মৌটুসিজাতীয় পাখি এসে ফুলের মধু খেতে লাগল। তিনি পটাপট বেশ কটা ছবি তুললেন। কিন্তু পাখিটি শনাক্ত করতে পারেননি। আমি বললাম, ‘বাসায় ফিরে ফেসবুকে আপলোড করেন, দেখি চিনতে পারি কি না।’ তবে, বর্ণনা শুনে কিছুটা ধারণা করতে পারলাম। কিন্তু সে পাখি এ পর্যন্ত কেউ রমনা উদ্যানে দেখেছেন বলে শুনিনি। রাতে ফেসবুকে ছবিটা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পাখিটার নাম-পরিচয় ও অভিনন্দন জানালাম। সম্ভবত দেলোয়ার হোসেনই এ দেশে এই পাখির প্রথম ছবি তোলার রেকর্ড গড়লেন।
এটি এ দেশের বিরল এক পাখি ‘সিঁদুরে হলুদ’ বা ‘মিসেস গোল্ডের মৌটুসি’ (Mrs. Gould¤s sunbird)। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cinnyris Cinnyris। বিখ্যাত ব্রিটিশ পক্ষীবিদ জন গোল্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ গোল্ডের নামে এই পাখির নামানুাসারে যিনি ছিলেন একজন চিত্রকর। জন গোল্ডের বেশ কটি পাখির বইয়ের ছবি উনি এঁকেছেন। জানামতে, দেলোয়ার হোসেনের আগে এস এম এ রশিদ ১৯৮৩ সালে টেকনাফে এবং ডেভিড জনসন ১৯৮৫ সালে লাউয়াছড়ায় এই পাখি দেখেছিলেন।
একরত্তি এই পাখির ওজন মাত্র ছয় গ্রাম। ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত লম্বায় মাত্র ১৪-১৫ সেন্টিমিটার, যার মধ্যে লেজ চার ও ঠোঁট দুই সেন্টিমিটার। বাহারি এই পাখির রঙের মেলা শুধু পুরুষ পাখি বা টোনার দেহেই দেখা যায়। অন্যান্য মৌটুসি-নীলটুনির মতো টুনির দেহ অনুজ্জ্বল জলপাই রঙের। লেজ ছোট ও গোলাকার। পেট হালকা হলদে। মাথা ও মুখমণ্ডল ধূসর বা নীলচে ধূসর। অন্যদিকে, বাহারি টোনার মাথার চাঁদি, মুখমণ্ডল, কান-ঢাকনি ও গলা ধাতব নীল থেকে বেগুনি। মাথার পেছন, ঘাড়, পিঠ ও দেহের ওপরটা সিঁদুরে লাল। ডানার ওপরটা জলপাই। বুক-পেট ও লেজের নিচের দিক হলুদ। লেজের পালক নীল। এদের চোখ বাদামি রঙের। ঠোঁট, পা ও নখ কালো।
নীলটোনা গানের পাখিও বেশ আমুদে। চমৎকার ‘জিট্-জিট্-জিট্’ স্বরে গান গায়। অন্যান্য মৌটুসির মতো ‘হোভারিং’ করে অর্থাৎ শূন্যে স্থির থেকে ফুলের মধু পান করে। মধুর অভাবে ছোট ছোট পোকা ও মাকড়সাও খেতে পারে। এরা বেশ চঞ্চল, বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এ-গাছ থেকে ও-গাছে, এ-ফুল থেকে ও-ফুলে উড়ে বেড়ায়।
সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে প্রজনন করে। গাছের পাতায় মাকড়সার জাল ও শেওলা দিয়ে ছোট্ট ঝুলন্ত বাসা বানায়। বাসার একদিকে থাকে ঢোকার মুখ। টুনি তাতে দু-তিনটি সাদাটে ডিম পাড়ে, যার ওপর থাকে হালকা লালচে-বাদামি ছিট। ডিম ফোটে ১৪-১৫ দিনে। তখন টোনার কী আনন্দ! ক্ষণে ক্ষণে ডাকতে থাকে। টোনাটুনি একত্রে মিলে বাচ্চাদের খাওয়ায়।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো  (১০/০৪/২০১৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics