নীরব বৃক্ষসখা
মুক্তার হোসেন, নাটোর
ইচ্ছা থাকলে কী না হয়। কথাটি আবারও প্রমাণ করলেন নাটোরের সিংড়ার আতাউল গণি (৩৬)। পেশায় আনসার সদস্য। বদলির স্বাভাবিক নিয়মে কখনো ঢাকা, কখনো রংপুরে অবস্থান করতে হয়। এই আতাউল গণি কর্মজীবনের সব ছুটি আর খাওয়া-পরার পর বেঁচে যাওয়া অর্থ উৎসর্গ করছেন সবুজ গড়ার আন্দোলনে। একের পর এক গাছ লাগিয়ে চলেছেন নিজ গ্রাম সিংড়ার চৌগ্রামের আশপাশের সরকারি জমিতে। বর্তমানে তাঁর লাগানো গাছের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। তাঁর এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের অন্যান্য যুবক যোগ দিয়েছেন এসব গাছ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে।
সবুজের স্বপ্ন: ১৯৯৬ সালে আনসারে যোগদানের পর দেখতে পান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যেই গ্রামের বেকার তরুণ-তরুণীদের সামাজিক বনায়নের উপদেশ দিচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ প্রশিক্ষণার্থী এই কর্মসূচি থেকে নিজে কতটুকু উপকৃত হবেন, তা নিয়েই মনোযোগী হতেন। স্যারদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে গিয়ে সামাজিক বনায়নের তেমন প্রসার দেখতে পেতেন না। স্যাররাও এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতেন। এই হতাশা আতাউল গণির মনে দাগ কাটে। তিনি ঠিক করেন, গ্রামের যুবকদের নিয়ে নিজের গ্রামের আশপাশটা সবুজে ভরে তুলবেন। ২০০৫ সালের ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি এসে গ্রামের কয়েকজন যুবককে ডেকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানান। কিন্তু সাড়া মেলে না। তাতে কী! তিনি একাই ধীরে ধীরে গাছ লাগানো শুরু করেন। ঈদের দিন বিকেলে চৌগ্রাম-বড়িয়া-ইটালি সড়কের দুই ধারে ৫০টি নিমের চারা লাগানোর মধ্য দিয়ে শুরু তাঁর সবুজ বিপ্লবের। তবে কিছুদিন যেতেই গ্রামের যুবকেরা তাঁকে সহযোগিতা করতে শুরু করেন।
সবুজের সীমানা: চৌগ্রাম-বড়িয়া-ইটালি রাস্তার প্রায় সাত কিলোমিটারজুড়ে এখন সবুজের বন্যা। রাস্তার দুই ধারে আম, খয়ের, নিম, বাবলা, খেজুর ও কুলগাছের বয়স এখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। এই রাস্তা ছাড়াও আতাউল গণি গাছ লাগিয়েছেন পাকুরিয়া থেকে বিক্রমপুর, ইটালি থেকে তিরাইল, চৌগ্রাম রথবাড়ী থেকে জামতলী, শিকিচরা থেকে ছতর হয়ে ডাকাতগাড়ী ও নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের লালঘর ব্রিজ থেকে চৌগ্রাম বাসস্ট্যান্ড ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে। মোট ১৫ কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে তিনি লাগিয়েছেন ৩০ হাজার গাছ। এসব গাছের মধ্যে তাল, জাম, ইউক্যালিপটাস, বেলজিয়াম, আকাশমণি, কাঠবাদাম, তেঁতুল, নিম, অর্জুন, হরীতকী, বহেড়া, কৃষ্ণচূড়াগাছ রয়েছে। রাস্তার বাইরেও বড়িয়া বাজার, বড়িয়া কবরস্থান, কদমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কদমা বাজার, চৌগ্রাম স্কুল ও কলেজ, ইটালি উচ্চবিদ্যালয়, চৌগ্রাম শ্মশান, চৌগ্রাম মন্দির ও চড়াগাড়ী দিঘির পাড়ে প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন জাতের গাছ লাগিয়েছেন।
চলতি মৌসুমে সিংড়ার শারদানগর থেকে হুলহুলিয়া খালের উভয় পাশে গাছ লাগানোর জন্য তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি পেলে এখানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার গাছ লাগানো শুরু করবেন।
আতাউল গণির রোপণ করা গাছগুলোর মধ্যে কিছু বেশ বড় হয়েছে। বড়িয়া-চৌগ্রাম-ইটালি সড়কের আমগাছগুলোর উচ্চতা ১০ থেকে ১১ ফুট। এ বছর কিছু আম ধরেছিল। খয়ের গাছ হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ ফুট। নাটোর-বগুড়া সড়কের লালঘর ব্রিজ থেকে চৌগ্রাম ব্রিজ পর্যন্ত গাছগুলো সাত থেকে আট ফুট। ইটালি থেকে তিরাইল রাস্তার ইউক্যালিপটাস ১২ ফুট, আম ৮ ফুট।
আতাউল গণি যখন কর্মস্থলে থাকেন, তখন গ্রামের যুবকেরা এসব গাছ দেখাশোনা করেন। এমনকি যাঁরা রাস্তায় নিয়মিত চলাচল করেন, সেই পথিকেরাও নিজ দায়িত্বে গাছগুলো দেখভাল করে থাকেন। কোনো সমস্যা হলে মুঠোফোনে তাঁকে জানিয়ে দেন। গ্রামের মা-বোনেরাও এসব গাছ থেকে তাঁদের গরু-ছাগল নিরাপদ দূরত্বে রাখেন।
উত্তম দৃষ্টান্ত: চৌগ্রাম মাঝিপাড়ার যুবক রুবেল হোসেন বলেন, ‘শুরুতে গণি ভাইয়ের কাণ্ড দেখে মনে হতো, এটা পাগলামি। পরে যখন রাস্তার দুই ধার সবুজ হয়ে উঠতে শুরু করল, তখন আমাদের ধারণা পাল্টে গেল। এখন আমরা তাঁর লাগানো গাছগুলো আমাদের সন্তানের মতো মনে করি।’
চৌগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ কর্মকার বলেন, গাছ লাগানোর বহু উপকার। এতে রাস্তার ক্ষয়রোধ হচ্ছে, পথচারীরা ছায়া পাচ্ছে, পাখির আবাসন হচ্ছে, ঔষধি গাছ চিকিৎসার কাজে লাগছে। আতাউল গণির এই উদ্যোগের জুড়ি নেই।
স্থানীয় চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামীমা হক বলেন, ‘আতাউল গণি আমার ইউনিয়নের কয়েকটি রাস্তা ও সরকারি জলাশয়ের পাশে বিভিন্ন জাতের ৫০-৬০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। এবারও একটি খালের দুই পাশে গাছ লাগানোর অনুমতি দিয়েছি। তাঁর পাশাপাশি গ্রামের অন্য যুবকেরাও এখন গাছ লাগানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।’ সিংড়া উপজেলার বন কর্মকর্তা এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, আতাউল গণির উদ্যোগ সামাজিক বনায়নের একটি উত্তম দৃষ্টান্ত।
সুবিধাভোগী: বড়িয়া-চৌগ্রাম-ইটালি সড়কের লাগানো গাছের সুবিধা ভোগ করার জন্য ৭০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাজাহান আলী বলেন, ‘এই রাস্তার কিছু আমগাছে এবার আম ধরেছিল। আমরা বিক্রি না করে এলাকার গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করেছি। এখানকার বিলাতি খয়ের গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে। পথযাত্রী ও মাঠে কর্মরত লোকজন সেখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারছেন।’
গাছগুলো বেঁচে থাক: নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে আতাউল গণি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার গাছ লাগানোর শখ ছিল। তবে বড় হয়ে দেখলাম, এটা শুধু শখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। সামাজিক জীব হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব। তাই কর্মস্থল থেকে যখনই ছুটি পাই, তখনই গ্রামে ছুটে আসি। নিজের খাওয়া-পরার খরচ মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে, তা গাছের পেছনে খরচ করি। এখনো বিয়ে করতে পারিনি। ভাবছি, আরও কিছু রাস্তাঘাট সবুজ করেই সংসার গড়ব।’ তিনি বলেন, ‘আমার লাগানো গাছের আম সবার জন্য উন্মুক্ত। ঔষধি গাছ যার যখন প্রয়োজন হচ্ছে, সংগ্রহ করছে। আমি চাই গাছগুলো শুধু বেঁচে থাক।’
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (১৩/০৭/২০১৩)