নোয়াখালীর উপকূলে নতুন ভূখণ্ডের হাতছানি

আকবর হোসেন সোহাগ

20130401_164806

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠেছে নিঝুম দ্বীপ। এ দ্বীপে গড়ে উঠেছে বসতি ও বনায়ন। এছাড়া হাতিয়ার পশ্চিম পাশে ঢাল চর, মৌলভীর চর, তমরুদ্দির চর, জাগলার চর, উত্তরে নলের চর, কেয়ারিং চর, ইসলাম চর, জাহাজ্জার চর, নঙ্গলীয়ার চর, সাহেব আলীর চর, দক্ষিণে কালাম চর, রাস্তার চরসহ অন্তত ১৫টি দ্বীপ ১৫-২০ বছর আগ থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে। যে মুহূর্তে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের এই অভাবনীয় সম্ভাবনা জনমনে সীমাহীন আশা জাগিয়েছে।

এগুলোর মধ্যেও নিঝুম দ্বীপে ৭০ হাজার লোকের বসবাস। এছাড়া ঢাল চর, নলের চর, কেয়ারিং চর, মৌলভীর চরসহ কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। একইভাবে বন বিভাগ আবাদ করে সবুজ বনায়ন করেছে। দস্যুদের ভয়ে বাকিগুলোতে এখনো বসবাস শুরু হয়নি। এখনো অন্তত ৪০-৫০টি ডুবো চর রয়েছে, যা আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে জেগে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ভাটায় দেখা গেলেও জোয়ারের পানিতে এখনো ডুবে যায়।

নিঝুম দ্বীপে প্রায় ৪৫ হাজার একর সংরক্ষিত বন এলাকা। এরই মধ্যে সাগরের বুকজুড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল আয়তনের ভূখণ্ড গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ বছর যুক্ত হবে আরও প্রায় ২ হাজার ২০০ মাইল ভূমি। নিঝুম দ্বীপ থেকে মুক্তারিয়া ঘাটসহ কয়েকটি ক্রস ড্যাম আর প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওই এলাকার আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার বর্গমাইল। বঙ্গোপসাগরের বুকে দেখা দিয়েছে আরেকটি বাংলাদেশের হাতছানি।

নিঝুম দ্বীপের কাছাকাছি এলাকায়ও কয়েকশ বর্গমাইল নতুন চর জেগে উঠেছে এবং ডুবো চর রয়েছে। নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণে ৪০-৫০ মাইল পর্যন্ত বড় বড় চরভূমির অস্তিত্ব রয়েছে। যে চরগুলো জেগে উঠেছে সেখানে এখন বাসোপযোগী স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত ইডিপির এক জরিপের সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত শুধু নোয়াখালী উপকূলেই সাড়ে ৯ বর্গমাইল ভূমি জেগে ওঠে এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত আরও দুই-তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ চরগুলো পরিকল্পিতভাবে স্থায়িত্ব দিতে সরকারি উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। বিষয়টি শীর্ষপর্যায়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্ব পাচ্ছে না। সমুদ্রবক্ষে সম্ভাবনার বিশাল আশীর্বাদ এসব ভূখণ্ড পরিকল্পিত ব্যবহার, বনায়ন ও সংরক্ষণে সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়নি এখনো। নিঝুম দ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে শুধুই ‘ডোবা চর’ হিসেবে পরিচিত চরগুলোতে এখন জনবসতিও গড়ে উঠেছে। একই ধরনের আরও প্রায় ২০টি ‘নতুন চর’ এখন স্থায়িত্ব পেতে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে দুই-তিন বছর ধরে জেগে থাকা এসব দ্বীপখণ্ড ভরা জোয়ারেও ডুবছে না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত শীঘ্রই বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন ভূখণ্ড ১৫-২০টি দ্বীপ যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নঙ্গলীয়া এলাকায় নতুন চর জেগে মেঘনা মোহনা জুড়ে বড় বড় আয়তনের নতুন ভূখণ্ড দেখা গেছে। সেসব চরে উড়ি ঘাস গজাতেও শুরু করেছে। নিঝুম দ্বীপ থেকে মুক্তারিয়ার ঘাট, উড়ির চর থেকে জাহাজ্জার চর পর্যন্ত ক্রসবাঁধ নির্মাণ করে এ মুহূর্তে অনেক ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব। হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপ-ধমারচর ক্রসবাঁধের মাধ্যমে মূল স্থলভূমির সঙ্গে সংযুক্ত করার খুবই চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে অচিরেই অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড মিলবে।

সাগর বুকে ভূমি উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেগুলো বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে উদ্ভাবনও করেছেন। যে মুহুর্তে জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখন্ড সমুদ্রের তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক সে মুহূর্তেই দেশের এই অভাবনীয় সম্ভাবনা জনমনে সীমাহীন আশা জাগিয়েছে।

কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০ বর্গমাইল নতুন চর জেগে ওঠে। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে জেগে ওঠা চরভূমির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বেড়ে উঠেতে দেখা যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মেঘনা মোহনা সমীক্ষায়ও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। পাউবো সমীক্ষায় বলা হয়, নদী ভাঙা-গড়ার খেলায় ভূমি প্রাপ্তির হারই বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর উপকূলেই সবচেয়ে বেশি ভূখণ্ড জেগে উঠছে। ইতোমধ্যে ক্রসবাঁধ পদ্ধতিতেও বঙ্গোপসাগর থেকে লক্ষাধিক হেক্টর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় এক হাজার বর্গ মাইল আয়তনের নতুন ভূখণ্ড পাওয়া গেছে। আরও কয়েকটি ক্রসবাঁধের মাধ্যমে নোয়াখালীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ সন্দ্বীপের সংযুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়েও এখন গবেষণা চলছে। এটা সম্ভব হলে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হবে।

অপরদিকে বন বিভাগের অবহেলায় নিঝুম দ্বীপে ৩০ হাজার হরিণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গাছ উজাড় করছে দস্যু ও জনপ্রতিনিধিরা। নোয়াখালীর উপকূলীয় হাতিয়া উপজেলার বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে নিঝুম দ্বীপে সরকারি বন বিভাগের উদ্যোগের অভাবে ও অযত্ন, অবহেলায় প্রায় ৩০ হাজার হরিণের অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। সেখানে আবাসন, খাদ্য সংকট, অকারণে শিকার বন্যা কুকুরের আক্রমণ ও পানীয় জলের অভাব প্রকট দেখা দিয়েছে। দুই বছর আগে নিঝুম দ্বীপে বিস্তীর্ণ বনে ফসলের মাঠে রাস্তা-ঘাট ও লোকালয়ে দেখা যেত মায়াবী হরিণের পাল। লবণাক্ত পানির কারণে রোগাক্রান্ত হওয়া এবং বনকর্মকর্তাদের অবহেলা এর মূল কারণ। নিঝুম দ্বীপ রেঞ্জ কর্মকর্তা জাবের হোসেন বলেন, সমস্যার সমাধান করা গেলে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার হরিণ রপ্তানি করা সম্ভব। প্রতিটি হরিণের মূল্য ২৫ হাজার টাকা ধরা হলে নিঝুম দ্বীপ থেকে প্রায়ই ৩০ কোটি টাকা আয় হবে। তা ছাড়া হরিণ রপ্তানি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ হরিণের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখার মতো জায়গা সংকট।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বনের আশপাশের খালি জমিতে ভূমিহীনদের বসবাস অন্যদিকে স্থানীয় দস্যু ও জনপ্রতিনিধিরা বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাগানের গাছ অবাধে কেটে পাচার করছে এ জন্য হরিণের অবাধে বিচরণে সমস্যা হচ্ছে। এতে বনের আয়তন কমে যাচ্ছে এবং হরিণের খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করছে। লবণাক্ত পানির কারণে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি। দ্বীপের ২৫ হাজার হরিণের জন্য একটি মাত্র মিঠা পানির পুকুরের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে পানি না থাকায় হরিণগুলো প্রায়ই চলে আসে লোকালয়ে। তাছাড়া বনের পর্যটকদের অবাধ বিচরণ খাদ্যের অভাব, রোগাক্রান্ত হওয়া, বন্যা- ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, পাগলা কুকুরের আক্রমণ ও প্রভাবশালীদের শিকারের কারণে হরিণগুলোর বেঁচে থাকা হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মুখে বিশাল বালুচরে হরিণের চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইদানীং বনদস্যুরা ওই খালি জায়গা দখলে নেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। এ জায়গা বন্দোবস্ত দেওয়া হলে আর হরিণ থাকবে না বলে দ্বীপবাসীরা জানান। এসব হরিণের চিকিৎসার জন্য বন বিভাগের নেই কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নেই কোনো পশু হাসপাতাল।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন  ২১/০৭/২০১৩

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics