পটুয়াখালীর নয়নাভিরাম চর

সঞ্জয় কুমার দাস

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে পটুয়াখালীর উপকূল জুড়ে প্রায় দু’শ থেকে আড়াইশ বছর আগে থেকে জেগে ওঠে ছোট-বড় অসংখ্য চর। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগর বা নদীবেষ্টিত দ্বীপাঞ্চলই হচ্ছে চর। বঙ্গোপসাগর বা সংলগ্ন নদী বক্ষে তার গতিপথে পানি বাধা পেয়ে পলি সঞ্চিত হয়ে যে ভূখণ্ড গড়ে ওঠে তাই হচ্ছে চর। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে পটুয়াখালী জেলায় শতাধিক চরের কথা বলা হলেও জনবসতি পূর্ণ চর রয়েছে ১৫০। ৩ হাজার ২৩২ বর্গমাইল আয়তনের এ জেলায় চরের সমতল ভূমি রয়েছে প্রায় অর্ধেক। প্রায় সব চরেই রয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নয়নাভিরাম বনভূমি। প্রাকৃতিকভাবে বা বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা এসব বনভূমিই চরের মানুষের ঝড়-বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের রক্ষাকবজ। জনবসতি গড়ে ওঠা চরগুলোতে প্রায় ৫ লাখ লোকের বাস। সাগর বা নদীতে মাছ শিকার ও কৃষিকাজই এদের মূল পেশা। অতীতে জেগে ওঠা পটুয়াখালীর একটি চর বর্তমানে উপজেলা ও তিনটি চর এখন দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। জেলার বেশির ভাগ চরে বসবাসরত মানুষগুলো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে নেই পরিকল্পিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নেই ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ। জেলা ও উপজেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন বেশির ভাগ চরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল। স্থানীয় মহাজন বা জোতদারদের তাঁবেদারির শৃঙ্খলে বাঁধা এসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন।

359fcf19422ae5fdf963d54d6a5e8549প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলে ৩ হাজার ২৩২ বর্গমাইল আয়তনের পটুয়াখালী জেলা। মোট আটটি উপজেলায় মোট লোকসংখ্যা ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ২২২ জন। জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর রয়েছে দেড় শতাধিক তবে জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী চরের সংখ্যা ১১১টি। এর মধ্যে রাঙ্গাবালী উপজেলা রয়েছে জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরাঞ্চল। এছাড়া প্রত্যেকটি উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে রয়েছে চরাঞ্চলে। জেলার মোট আয়তনের ১৩০০ বর্গকিলোমিটার রয়েছে জনবসতিপূর্ণ চর। জেলায় দেড় শতাধিক চরে বসবাস করছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। এ সব চরের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সঙ্গে জীবনবাজি রেখে তালমিলিয়ে বসবাস করছে।

ধারণা করা হচ্ছে, আড়াই শ বছর আগে পটুয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠে বহু ছোট-বড় চর। চরগুলোতে আস্তে আস্তে গাছপালা জন্মে সৃষ্টি হয় বিশাল সমতল ভূমি ও বনভূমি। আর এ বনভূমির কিছু অংশ পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করে মগ বা রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ।

জানা গেছে, দুই শ থেকে আড়াই শ বছর আগে বর্মি রাজার অপশাসন থেকে পরিত্রাণের জন্য ওই রাজ্যের আরাকান এলাকা থেকে মগ সম্প্রদায়ের বহু পরিবার তাদের সদস্যদের নিয়ে নৌকা বা সাম্পানযোগে পালিয়ে এসে পটুয়াখালী উপকূলের বিভিন্ন এলাকার চরগুলোতে আশ্রয় নেয়। তারা যে সব এলাকায় বসবাস করে ওই স্থানের নামকরণ করে তাদের সম্প্রদায়ের মাদবরের নামে।

রাঙ্গাবালী ছাড়া জেলার বেশির ভাগ চরই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে। স্থানীয়ভাবে দাদনদার, মহাজন বা প্রভাবশালীদের ইশারায়ই চলে সবকিছু। তাদের কারণে অনেক সময় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলররা চেষ্টা করেও বহু সমস্যার সমাধান দিতে পারেন না। জমিজমা নিয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে বহু পরিবারের।

জেলার চরগুলোর মধ্যে তিনটি চর এখন দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। এছাড়া সেনারচর ও ফাতরার বন রয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান। যেখানে রয়েছে মাইলের পর মাইল সৈকত। যে স্থানগুলোতে সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। এসব পর্যটন কেন্দ্রে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসে তাদের ভ্রমণ পিপাসা মেটাতে। রয়েছে বিশাল বনভূমি, হরিণসহ নানান বন্যপ্রাণী।

নদী ভাঙনগ্রস্ত ও সহায়সম্বলহীন মানুষই চরে অবস্থান করে। প্রায় সব চরেই স্থায়ী জনবসতি গড়ে উঠেছে। বন্যা ও বর্ষা মৌসুমে জোয়ার-ভাটার উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এসব চরে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করা সম্ভব হয় না মানুষের। কিছু কিছু চরে ফসল, সম্পদ ও জনবসতি রক্ষার জন্য বাঁধ রয়েছে। ওই সব চরে জনবসতি বেশি এবং ফসলেরও চাষাবাদ হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো চরে ভরা জোয়ার বা অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের পানির প্লাবন থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নেই। এসব চরে ফসল উৎপাদনের বিষয়টি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। চর এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যেমনি মিলেমিশে বসবাস করছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। তাই সম্পদের মালিকানা স্বত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হতবিহ্বল মানুষগুলো সরকারি সুযোগ-সুবিধা তো ঠিকভাবে পায়ই না, বরং প্রতিনিয়ত প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে দিনযাপন করছে চরবাসী। জেলার ৫২টি চর নিয়ে কাজ করে বেসরকারি এনজিও সংস্থা স্পিড ট্রাস্ট। তাদের সুনির্দিষ্ট একটি জরিপে বেরিয়ে এসেছে চরবাসীর প্রত্যাশা। ওই এনজিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. হেমায়েত উদ্দিন জানান, চরবাসীর মূল প্রত্যাশা হলো খাসজমি বন্দোবস্ত পেয়ে জমির মালিকানা অর্জন, আয়ের সুযোগ ও জীবিকা নির্বাহ এবং নদী ভাঙনের শিকার হয়েও একই চরে বসবাস করা।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন ২২/০৭/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics