পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিবেচনায় কোরবানি ও বর্জ্যরে বিকল্প ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে- পবা
পবিত্র ঈদ-উল-আযহা সমাগত প্রায়। ঈদ-উল-আযহার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে লাখ লাখ পশু কুরবানি হবে দেশ জুড়ে। চলমান শহরমুখী প্রবণতায় আগামি ১৫/২০ বছরের মধ্যে কেবল ঢাকাতেই প্রায় ২ কোটি পশু কুরবানি হবে। এই বিপুল সংখ্যক কুরবানির পশুর যোগান দিতে উৎপাদন, বাজারজাত করার জন্য পরিবহন, হাট ব্যবস্থাপনা এবং কুরবানির মাধ্যমে প্রচলিত ব্যবস্থায় দুষণ বিষয়ে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। সময়ের বিবর্তনে জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও পরিবেশ বিবেচনায় প্রচলিত অব্যবস্থাপনার বিপরীতে সৌদি আরবের আদলে অথবা অন্য কোন অধিকতর ভাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকারকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। আজ ০৮ অক্টোবর ২০১৩, সকাল ১০:৩০ মি. ঢাকা রিপোর্টার্স ইফনিটিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দেলন (পবা) আয়োজিত এক আলোচনা সভা থেকে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
বক্তারা বলেন- মহানগরী ঢাকায় বর্তমানে যে পরিমাণ কুরবানি হচ্ছে এতেই শহরের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। শহরমুখী প্রবণতায় আগামিতে এ সংখ্যা কয়েকগুণ হবে। ঢাকাতেই প্রায় ২ কোটি কুরবানি হবে। তখন কুরবানির পশুর যোগান দিতে উৎপাদন, বাজারজাত করার জন্য পরিবহন, হাট ব্যবস্থাপনা এবং কুরবানির মাধ্যমে প্রচলিত ব্যবস্থায় দুষণের একটি আগাম চিত্র যদি আমরা চিন্তা করি তবে দেখতে পাই- ২ কোটি কোরবানির পশুর যোগান দিতে জেলাগুলো থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি কোরবানির পশু বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনা হবে। ঈদে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি এই বিশাল সংখ্যক কোরবানির পশুর পরিবহনে রাস্তার উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়বে, যানজটে নতুন মাত্রা যোগ হবে। শহর জুড়ে যত্রতত্র হাট বসবে। গোবর, মুত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। খড়, ঘাস, খৈল, ভূষি, পানির যোগান দিতে খোলা জায়গা দখল করে এসবের মজুদ রাখতে হবে। পশু ধোঁয়ানোতে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হবে, আশেপাশের পরিবেশ নোংরা হবে। প্রচলিত ব্যবস্থায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বা পাশের ড্রেনে যত্রতত্র যেভাবে কুরবানি দেয়া হচ্ছে এ অবস্থা চলতে থাকলে ড্রেনগুলোর বর্জ্য বহনের ক্ষমতা থাকবে না। ফলে রক্ত, গোবর উচ্ছিষ্টাংশ ড্রেনগুলোতে অনেক দিন আটকে থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে, রোগ-ব্যাধি আশংকাজনকহারে বাড়বে। মাত্রাতিরিক্ত ব্লিচিং পাউডার ব্যবহারের ফলে নদী জলাধারের পানি দূষিত হবে। অনেক জলজ প্রাণী মারা যাবে, জীববৈচিত্রে প্রভাব পড়বে।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, আনন্দ পাঠের নির্বাহী প্রধান কায়সার আহমেদ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।
আলোচনা সভা থেকে বলা হয়- সারা দেশের প্রেক্ষিতে যদি আমরা বিবেচনা করি তবে দেখব দেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যা আগামিতে ২৫/৩০ কোটিতে উন্নীত হবে। এর মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষের কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য হবে। প্রতিবছর ৫ কোটি পশু কুরবানির জন্য কমপক্ষে ২০ কোটি পশু পালন করতে হবে। এই ২০ কোটি পশুর থাকার জায়গা ও ঘাস উৎপাদনে বিশাল জমির প্রয়োজন হবে। নিউজিল্যান্ডে অধিক গরু উৎপাদনের ফলে গো-মূত্রে ভূ-গর্ভস্থ স্তরের পানি পানের অযোগ্য হচ্ছে। এ দিকগুলোও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
চামড়া যেভাবে অপরিপক্ক লোকের মাধ্যমে ছাড়ানো হচ্ছে। তাতে অনেক চামড়াই ব্যবহার অনুপযোগী হচ্ছে। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে কোরবানির ব্যবস্থা করলে চামড়া ছাড়ানোর লোকের সমাবেশ করা সহজ হবে। প্রচলিত ব্যবস্থায় একটা গরু জবাই ও আনুসাঙ্গিক কাজ সাড়াতে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পরিকল্পিতভাবে করলে তা অল্প খরচেই করা সম্ভব হবে। সঠিকভাবে চামড়া ছাড়ানো হলে এর মূল্যও বেড়ে যাবে। নির্ধারিত স্থানে, সঠিক ব্যবস্থাপনায় কোরবানি করা হলে রক্ত, হাড়, চামড়া এসব উচ্ছিষ্ট অংশ সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করা যাবে। হাড়, উচ্ছিষ্টাংশ বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যাবে। পরিবেশ ভাল থাকবে, বাজেটের উপর চাপ কমবে।
পশু কোরবানিতে পরিবেশ দূষণের বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টি ও সঠিক ব্যবস্থানা আবশ্যক। মক্কা নগরীসহ মধ্য প্রাচ্যের প্রায় সকল নগরী এক্ষেত্রে আমাদের আদর্শ হতে পারে। মক্কা নগরীসহ মধ্য প্রাচ্যের প্রায় সকল নগরীতে নির্ধারিত স্থান ছাড়া কোরবানির পশু জবাই করা নিধিদ্ধ। ফলে সেখানে পরিবেশ দূষণ বা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কোন সম্ভাবনাও থাকে না। নির্ধারিত পরিচ্ছন্ন জায়গায় কোরবানি দিলে মাংসে আবর্জনা ও জীবাণু মিশ্রনের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে ফলে মান সম্পন্ন মাংস পাওয়া সম্ভব হবে। কোরবানির পশুর রক্তে খুব উৎকৃষ্ট মানের সসেজ তৈরী সম্ভব যা উন্নত অনেক দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পশুর ফেলে দেয়া নাড়ি-ভুড়ি থেকে উৎকৃষ্ট মানের মাছের খাদ্য বা পশু খাদ্য তৈরী করা সম্ভব একইভাবে পশুর হাড় গুড়ো করে পশু খাদ্য বা উৎকৃষ্ট মানের সার তৈরী করা যায়। ফলে নগরী দূষণমুক্ত থাকবে, জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবে না। অন্যদিকে কোরবানির উচ্ছিষ্ট সমূহের সম্পদে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সহ কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। অনেক সময় অনভিজ্ঞ লোকের দ্বারা কোরবানি পশুর চামড়া অপসারণ করা হয়। ফলে মূল্যবান চামড়া নষ্ট হয়ে যায় এতে চামড়ার দামও কমে যায়। অন্যতম রপ্তানী পন্য চামড়ার ক্ষতি জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কুরবানি ও এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প ভাবনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সিটি করপোরেশনকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নিদিৃষ্ট জায়গায় সঠিক ব্যবস্থঅপনার মাধ্যমে কুরবানি দিতে হবে। কোরবানির পশু জবাইয়ের পর উচ্ছিষ্ট রক্ত, হাড়, চামড়া, গোবর, নাড়ি-ভুড়ি আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হবে। পরবর্ততে তা সম্পদে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। কমিউনিটি ভিত্তিক সচেতনতা ও উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক কুরবানি ও এর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিকল্প সমাধান বের করতে হবে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক