
সিঁদুরে সাহেলির রঙের বাহার
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
‘ঘুমভাঙার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুমও ভাঙল বড় সুন্দর একচমকে! এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি একজোড়া স্কার্লেট মিনিভেট এসে বসেছে আমগাছের মাথায়। আমার ঘুম ভাঙানিয়াপাখিরা! আহা, রোজই যদি আসত!’ বুদ্ধদেব গুহ তাঁর বিখ্যাত ‘মাধুকরী’ উপন্যাসে পাখিটিকে এভাবেই তুলে ধরেছেন।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেএকাধিকবার পাখিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের দেহে রয়েছে ভিন্নভিন্ন রঙের কারুকাজ। রঙের এই ভিন্নতা ও লৈঙ্গিক পার্থক্য ওদের রক্ষা করেবিপন্নতার হাত থেকেও। ‘টিউই-টিউই-টিউই…’ স্বরে মাতিয়ে বেড়ায় বুনোপ্রকৃতি। ডালের উচ্চতায় বসে আপন মনে ডাকতে থাকে ওরা। বনের নির্জনতায় এমনসুমিষ্ট ডাক ভালোলাগার শিহরণ জাগায়।পাখিটির ইংরেজি নাম Scarlet Minivet, বৈজ্ঞানিক নাম Pericrocotus flammeus. সিঁদুরে সাহেলি ছাড়াও একেলাল সাতসাহেলি, লালপরী, সায়েলি নামেও ডাকা হয়। শহরে বিচরণকারী পাখিদেরতালিকায় এরা পড়ে না।
স্বনামধন্য পাখি পর্যবেক্ষক, গবেষক ওপ্রকৃতিবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রোনাল্ড হালদার কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কারলেট মিনিভেট সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একে প্রাকৃতিক বনছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, সেগুন প্রভৃতিগাছগাছালির কৃত্রিম বাগানও এরা এড়িয়ে চলে। কেননা দেশি গাছগাছালি ওলতাগুল্মে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক বনের বাসিন্দা ওরা। অনেকেরই ধারণা যেপ্রাকৃতিক বন কেটে নিজেদের পছন্দমতো গাছ লাগালেই পাখিদের আগমন ঘটবে!ধারণাটা ভুল। বহু পাখি আছে যাদের সঙ্গে প্রতিটি গাছের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।কী ধরনের গাছ, কী ধরনের বন, বনের অবস্থা কেমন- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরওপর নির্ভর করে এ জাতীয় পাখিদের অস্তিত্ব ও বংশবিস্তার। ‘মিনিভেট’ পাখিগুলোর বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক বনের প্রয়োজন। এই পাখিকে তিন ধরনেরবনে দেখা যায়- শালবন অর্থাৎ পাতাঝরা বন, পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরহরিৎ বনআর সুন্দরবন অর্থাৎ প্যারা বন।
রোনাল্ড হালদার আরো বলেন, ছেলেপাখির দেহের নিচের দিক টুকটুকে লাল ও পিঠের দিক চকচকে নীল-কালো। আর মেয়েটিরদেহতলে হলুদের অনুজ্জ্বল আভা- এমন চমৎকার রঙের সংমিশ্রণ খুব কম পাখিরমধ্যেই রয়েছে। এই প্রজাতির পাখির মধ্যে শুধু পুরুষদের গায়ের রং গাঢ় লাল হয়েথাকে। স্ত্রীদের গায়ের রং হালকা হলুদ। পুরুষ পাখির মাথার রং কালো এবংপিঠের পালকে কালো রঙের ছোপ। স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য প্রজাতির ছেলে পাখিগুলোসুন্দর হয়ে থাকে বেশি এবং ওই একই প্রজাতির মেয়ে পাখিটি অপেক্ষাকৃত কমসুন্দর হয়ে থাকে। কিন্তু সিঁদুরে সাহেলির ছেলেমেয়ে উভয়ের দেহই চমৎকার রঙেরসৌন্দর্যে রাঙানো।
সিঁদুরে সাহেলি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি।সচরাচর জোড়ায় বা ঝাঁকে দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের পাখি। এদের দৈর্ঘ্য২২ সেন্টিমিটার, ওজন মাত্র ২৬ গ্রাম। এই বৈশাখে ওরা বাচ্চা ফোটাচ্ছে।গাছের গায়ে চরে বেড়ানো ছোট ছোট পোকামাকড় খায়। সুন্দরবনসহ সিলেট, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল ও রংপুরের প্রাকৃতিক বন-জঙ্গলে এদের প্রায়ই দেখা যায়।
বাংলাদেশছাড়াও ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে সিঁদুরে সাহেলির বিচরণ রয়েছে।পৃথিবীতে ১৩ প্রজাতির মধ্যে আমাদের দেশে ছয়টি প্রজাতির মিনিভেটের বিচরণরেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি আবাসিক এবং অবশিষ্ট চারটি পরিযায়ী পাখি।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক,
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ
এবং
স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর.কম
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র: ২৭এপ্রিল২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।