পানির গুনাগুণ পরীক্ষায় বুড়িগঙ্গা জলজ প্রাণশূণ্য

ঢাকা মহানগরীর জনস্বাস্থ্যে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণমাত্রা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের জন্য পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র উদ্যোগে একটি বিশেষজ্ঞ টিম আজ ২১ জানুয়ারী ২০১৪, সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে পাগলার বিভিন্ন পয়েন্টে পানির দূষণমাত্রা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে।

পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, নদীতে কোন ধরণের মৎস ও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার কোনই সুযোগ নেই। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (উঙ) ও পিএইচ (ঢ়ঐ) মাল্টিমিটারের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। প্রাপ্ত পরীক্ষায় দেখা যায় সদরঘাট এলাকায় ডিও এর পরিমাণ ০.৪০ মিলিগ্রাম/লিটার, ধোলাইখালে ০.৩৮ মিলিগ্রাম/লিটার, পোস্তাগোলা-শ্মশানঘাটে ০.৫৫, শ্যামপুর খালের ভাটিতে ০.৬২ মিলিগ্রাম/লিটার, পাগলা ওয়াসা ট্রিটমেন্ট প্লান্টের নির্গমন ড্রেনের ভাটিতে ০.৩৩ মিলিগ্রাম/লিটার, পাগলা বাজার ০.৩০ মিলিগ্রাম/লিটার। নদীর দক্ষিণ পাড়ে বসুন্ধরা ইয়ার্ড এ ০.১৪, পানগাঁওয়ে ০.২৩, ডকইয়ার্ড এ ০.২১ মিলিগ্রাম/লিটার। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে নদীর দক্ষিণ পাড়ে ইয়ার্ড এলাকায় ডিও এর পরিমাণ সবচেয়ে কম। ড্রেনের পানিতে পিএইচ ১০.৩২, খালের মুখে ৯.৯৯ পাওয়া যায়। ঢ়ঐ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শ্যামপুর এলাকার শিল্পকারখানা এবং ডিএনডি বাঁধের টেক্সটাইল ডাইং ও ওয়াশিং এর বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা হচ্ছে। নদীতে পরীক্ষাকৃত স্থানসমূহে ঢ়ঐ ৭.৯ থেকে ৮.৯৮ পাওয়া যায়। ওয়াসার পাগলা পয়:পরিশোধনাগার থেকে নির্গত বর্জ্যে ডিও প্রতি লিটারে ২.১৬ মিলিগ্রাম এবং পিএইচ ৮.৮৪ যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে পরিশোধনাগার বর্জ্য পরিশোধনে কার্যকর কোন ভ’মিকা রাখছে না।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী মৎস ও জলজ প্রাণীর জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫মিলিগ্রাম/লিটার বা তার উর্ধ্বে থাকা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে পানিতে ঢ়ঐ এর মাত্রা ৭ থাকা বাঞ্চনীয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান এর নেতৃত্বে পরিক্ষা ও পর্যবেক্ষণ টিমে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা সামিউল হক সজিব প্রমুখ।Burigonga_POBA

পরিদর্শনকালে কোথাও কাউকে মাছ ধরতে দেখা যায়নি। যা পরীক্ষার ফলাফল ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শ্যামপুর ড্রেন থেকে নদীতে রঙিন পানি পড়তে দেখা যায়। এছাড়াও পরিদর্শনকালে নদীর দুপাশে বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি ও কঠিন বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। নদীর পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর দক্ষিণ পাশে ইয়ার্ড এলাকায় প্রচুর তেল ভাসতে দেখা যায়। এছাড়াও নৌযানগুলি মেরামতকালে রংমিশ্রিত লৌহ কণা নদীতে পড়ছে। যাতে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিকর ভারি ধাতু বিদ্যমান।

পবা ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিমাসে বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন নির্ধারিত স্থানের উঙ, ঢ়ঐ -র পরিমাণ পরীক্ষা করে আসছে। পরীক্ষাকৃত নির্ধারিত স্থানে উঙ প্রতি লিটারে জুন/১৩ মাসে ০.২৪ থেকে ০.৭৯ মিলিগ্রাম, জুলাই/১৩ মাসে ৪.৫১ থেকে ৪.৭২ মিলিগ্রাম, আগস্ট/১৩ মাসে ২.৬১ থেকে ৪.৩৩ মিলিগ্রাম, সেপ্টেম্বর/১৩ মাসে ২.৮৬ থেকে ৫.০৩ মিলিগ্রাম, অক্টোবর/১৩ মাসে ০.৯৩ থেকে ২.২৭ মিলিগ্রাম, নভেম্বর/১৩ মাসে ০.৩০ থেকে ০.৬৮ মিলিগ্রাম, ডিসেম্বর/১৩ মাসে ০.১২ থেকে ০.৩৫ মিলিগ্রাম। পি এইচ জুন/১৩ মাসে ৭.২৭ থেকে ৭.৩৭ মিলিগ্রাম, জুলাই/১৩ মাসে ৭.৩২ থেকে ৭.৪২ মিলিগ্রাম, আগস্ট/১৩ মাসে ৭.৩ থেকে ৭.৩৪ মিলিগ্রাম, সেপ্টেম্বর/১৩ মাসে ৭.৩৪ থেকে ৭.৫২ মিলিগ্রাম, অক্টোবর/১৩ মাসে ৭.৪ থেকে ৭.৬৫ মিলিগ্রাম, নভেম্বর/১৩ মাসে ৭.৭৯ থেকে ৭.৮৭ মিলিগ্রাম, ডিসেম্বর/১৩ মাসে ৭.৩২ থেকে ৭.৮৭ মিলিগ্রাম।

ঢাকা মহানগরীর জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এসব নদী বিশেষ করে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন নেই বললেই চলে। ফলে মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী। ঢাকা মহানগরীর পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্য(কঠিন বর্জ্য), হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম কারণ।

পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্য(কঠিন বর্জ্য), হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম কারণ। ঢাকা মহানগরীতে পয়ঃবর্জ্যরে পরিমাণ ১৩ লক্ষ ঘনমিটার। যার মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১২ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানির গুণগত মানের অবনতি; মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি; শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার অনুপযোগী; জীবানুজনিত দূষণ; মানুষের স্বাস্থ্যের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ হতে দৈনিক ২১,০০০ কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, পশুর মাংস, ইত্যাদি। ট্যানারী হতে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য শুধু বুড়িগঙ্গার পানিকেই দূষিত করছে না, নদীর তলদেশ ও উভয় পাড়ের মাটি এমনকি বাতাসকেও ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। ট্যানারীগুলো সাভার ও কেরানীগঞ্জে চামড়া শিল্প নগরীতে সরানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় নদীর দূষণ মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে।

টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্যসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে পড়ছে। অনেক শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই, আবার যে সব শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার রয়েছে তা চালু রাখা হয় না। ফলে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী অধিদপ্তর কর্তৃক পরীক্ষিত ১৩টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান খুব খারাপ এবং শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে কোন প্রাণ বাঁচতে পারবে না।

ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নৌযানের মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকে। এছাড়াও নৌযানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মালামাল পরিবহন করা হয়ে থাকে। নৌযানসমূহে সৃষ্ট বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার কোন স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে।

নদী রক্ষায় করণীয় ঃ পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন; গৃহস্থালী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকা; ট্যানারীগুলো জরুরীভিত্তিতে স্থানান্তর এবং বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন ও বর্জ্য পরিশোন করা; শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন এবং নিয়মিত তা পরিচালনা করা; নৌযানের ডিজাইনে বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা; বিআইডব্লিউ কর্তৃক নৌযানের বর্জ্য সংগ্রহকরণ ও তা পরিশোনপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ; নৌযানের বর্জ্য ও তেল নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা।

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics