
বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই যমুনায় দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত
শামছুর রহমান শিশির : যমুনা নদীসহ যমুনার শাখা নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যেই যমুনা ও শাখা নদী করতোয়া নদীর দুই পাড়ের নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হতে শুরু করেছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধি শুরু পর থেকেই যমুনা নদী তীবরর্তী শাহজাদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সেই সুযোগে বর্তমান প্রজনন মৌসুমে যমুনাসহ শাখা নদীগুলোতে অসাধু জেলেদের অপতৎপরতা পূর্বের তুলনায় বহুলাংশে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব অসাধু জেলেরা অবৈধ কারেন্ট, বাদাই, মশারিজালসহ অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রওয়ালা বিশিষ্ট জাল দিয়ে যমুনা নদী থেকে ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ শিকারের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে,‘যমুনায় পানি বৃদ্ধি শুরু পর থেকেই দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির ডিমওয়ালা মা মাছের প্রজনন সবচাইতে বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে। এ সময় যমুনা নদীতে পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নির্বিচারে নিধন রোধ করা না গেলে শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদীসহ এর বিভিন্ন শাখা নদীতে দেশীয় প্রজাতির মাছের চরম আকাল দেখা দেবে। ফলে নদীমাতৃক দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে মাছ আমদানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। এজন্য বর্তমান সময়ে যমুনা ও শাখা নদীগুলোতে দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ নির্বিচারে নিধন বন্ধের জন্য সংশ্লিষটদের অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।
যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শন, এলাকাবাসী ও মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যমুনা নদীর শাহজাদপুর অংশসহ পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর, পাবনা জেলার বেড়ার আংশিক, মানিকগঞ্জ, রংপুর, বগুড়ার গাবতলী, সারিয়াকান্দি ও টাঙ্গাইল অংশে শত শত ছোট বড় নৌকা নিয়ে অসাধু জেলেরা কারেন্ট, বাদাই, মশারিসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ছিদ্রওয়ালা নিষিদ্ধ জাল দিয়ে নির্বিচারে পোনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ শিকার করে নদী তীরবর্তী হাটবাজারে বিক্রি করছে। যমুনা নদী তীরবর্তী অসাধু জেলেরা দেশীয় প্রজাতির পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নির্বিচারে নিধনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ অপকর্মের মহোৎসবে মেতে উঠলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে অবৈধ কারেন্ট, বাদাই, মশারিজালসহ অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রবিশিষ্ট জাল দিয়ে যমুনা নদীসহ মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নিধনে মাছের প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। বিজ্ঞ মহলের মতে, চিরায়ত ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি ধীরে ধীরে কল্পবাক্যে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া যমুনা তীবরর্তী বিস্তৃত জলসীমা অবৈধ দখলদারদের করায়ত্ত হওয়ায় জেলেরা অবৈধ এ কর্মকা- দোর্দ- প্রতাপের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, যমুনা তীবরর্তী শুধুমাত্র শাহজাদপুর উপজেলাতেই প্রতিদিন অসাধু জেলেরা বিভিন্ন ধরনের অবৈধ জাল দিয়ে হাজার হাজার লাখ লাখ টাকার দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ শিকার করছে। ফলে শাহজাদপুর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য যমুনা নদী এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো দেশীয় প্রজাতির মা মাছ ও পোনা মাছ শূন্যপ্রায় হয়ে পড়েছে। যমুনা নদী তীরবর্তী এসব ইউনিয়নগুলো হলো জালালপুর, কৈজুরী, সোনাতনী ও গালা। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী চক্র স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে জেলেদের নামে মৎস্য আহরণের অনুমোদন না নিয়েই মাছের প্রজনন মৌসুমে অবাধে পুরোদমে এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধি শুরুর পর থেকেই এ অবস্থা চলতে থাকায় যমুনা নদীর শাহজাদপুরের এ অংশসহ পার্শ্ববর্তী গাবতলী, সারিয়াকান্দি, সরিষাবাড়ী, কাজিপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর, বেড়ার আংশিক, মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিস্তৃত জলসীমায় আর দেশীয় প্রজাতির মাছ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। অসাধু জেলেদের প্রতাপে অবৈধ কারেন্ট, বাদাই ও মশারি জালসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির ছিদ্র জালে ধরা পড়ছে পোনা ও ডিমওয়ালা দেশীয় প্রজাতির মাছ। এব্যাপারে মাঝে-মধ্যে পত্রিকায় লেখালেখি হলে সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই যমুনা নদী তীরবর্তী দুর্গম গাঁওগেরামের জেলেদের কাছ থেকে নৌকাপ্রতি মাসোহারা নেয়ায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মৎস্য বিভাগের কতিপয় রক্ষক নামধানী ভক্ষকের এহেন কর্মকা-ে বড় বাবুদের অভিযানের খবর আগেভাগেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জেলেদের কানে পৌঁছে যাওয়ায় যমুনা নদীর শাহজাদপুর অংশসহ পার্শ্ববর্তী বিশাল এলাকায় প্রতাপশালী জেলেদের অবৈধ জাল বরাবরই প্রশাসনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ শিকার পুরোদমে চলছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, ‘দেশে আমিষের চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয়ে থাকে যমুনা, পদ্মা, মেঘনা নদী, চলনবিলসহ মিঠা পানির নদ-নদীগুলো থেকে। এজন্য এসব নদ-নদীগুলোতে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ নির্বিচারে নিধন বন্ধ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ঘাটতি দেখা দেবে এবং ভারতীয় রুই আমদানির মতো বিদেশ থেকে মাছ আমদানির ওপর দেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে’।
সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব (০৯/০৬/২০১৩)
http://www.dailyinqilab.com/details_news.php?id=113335&&%20page_id=%208