
বাংলাদেশে অতি বজ্রপাত কেন বাড়ছে ?
শুধু কি জলবায়ু? নাকি বায়ূ দূষণ এবং মৌসুমী বায়ূ?
বাংলাদেশে বজ্রপাত এখন শুধু প্রকৃতির রোষ নয়—এটা হয়ে উঠেছে এক দৈনন্দিন বিপদ। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। মাঠে কাজ করা কৃষক, স্কুলের ছাত্র, অথবা গৃহস্থের উঠানে বসা সাধারণ মানুষ—কেউই রেহাই পাচ্ছে না।
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রকাশ পেল এক চমকপ্রদ সত্য—বজ্রপাতের হার বাড়ার পেছনে দায়ী আমাদের নিজেদেরই তৈরি করা বায়ু দূষণ। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী দেশ থেকে ভেসে আসা ধোঁয়া আর ধূলিকণাও এর জন্য দায়ী।
এই গবেষণাটি সদ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘আর্থ সিস্টেমস এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ নামক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে। গবেষণার নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান, যিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. এ.টি.এম সাদ্দাম আজম, নাসরীন আকতার, এম রফিকুদ্দিন এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমার গবেষক মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা ।
বছরের কোন সময়ে বজ্রপাত বেশি হয়?
বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনা বছরে সমানভাবে ঘটে না। গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাত সাধারণত দুইটি সময়ে বেশি হয়: প্রথম দফা (এপ্রিল-মে): গ্রীষ্মের শুরুতে বজ্রপাতের হার সবচেয়ে বেশি থাকে। গরম ও শুকনো বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে ধুলা ও দূষণ। দ্বিতীয় দফা (আগস্ট-সেপ্টেম্বর): বর্ষার শেষভাগেও বজ্রপাতের সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। অন্যদিকে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বজ্রপাতের সংখ্যা খুবই কম। এই সময়কে বলা যায় নিরব সময়—যখন আকাশও থাকে শান্ত। গবেষকরা বলছেন, এই ভিন্নতা কেবল মৌসুমি আবহাওয়ার কারণে নয়, বরং বায়ু দূষণ ও বায়ু প্রবাহের দিকও এর সঙ্গে জড়িত।

ধূলিকণা, সালফেট আর বজ্রপাত: অদৃশ্য সম্পর্ক
গবেষকরা ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রায় ৭৫০ দিনের বজ্রপাত সংক্রান্ত উপগ্রহচিত্র ও বায়ুমণ্ডলের গ্যাস-উপাদানের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া প্রায় ১,৪০০ বজ্রপাতবিহীন দিনেরও তথ্য তারা বিশ্লেষণ করেছেন তুলনামূলকভাবে। তাঁরা দেখতে পান, বজ্রপাত বেশি হওয়া দিনগুলোতে কিছু নির্দিষ্ট দূষণ উপাদান আকাশে অনেক বেশী পরিমাণে উপস্থিত ছিলো। যেমন, ধূলিকণা (Dust), এপ্রিল-মে মাসে বজ্রপাতের দিনগুলোতে ধূলিকণার পরিমাণ গড়ে অন্য সময়ের তুলনায় ৮৮% বেশি। সালফেট (SO₄) ৫১% বেশি, এবং ওজোন (O₃): ৬% বেশি। এই উপাদানগুলো বজ্রঘন মেঘ তৈরিতে এবং বিদ্যুৎ চার্জের বিনিময়ে সহায়তা করে। ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অপরদিকে, সূক্ষ্ম কণা (পিএম-১, পিএম-২.৫, পিএম-১০) যেগুলো গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানা বা কাঠ পোড়ানো থেকে আসে, সেগুলো শীতকালে বেশি থাকে। তবে এগুলোর উপস্থিতি বজ্রপাতের হার কমিয়ে দেয়, কারণ এই কণাগুলো বিদ্যুৎ চার্জের বিনিময় ব্যাহত করতে পারে।
দূষণের ঢেউ আসে বাতাসের পিঠে চড়ে
শুধু স্থানীয় দূষণ নয়—এই গবেষণায় উঠে এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ অনেক দূর থেকে বাংলাদেশে দূষণ বহন করে আনে। এপ্রিল-মে: এই সময়ে পশ্চিম দিক থেকে উচ্চ-স্তরের বাতাস আসে। তা ভারত ও মধ্য এশিয়া থেকে ধূলিকণা ও সালফেট নিয়ে এসে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর: দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসা বর্ষার বাতাস তুলনামূলকভাবে কম দূষণ বহন করে। এই বাতাসের গতিপথ অধিকমাত্রায় বজ্রপাতের জন্য ‘ইন্ধন’ জোগায়।
অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন:
“এই গবেষণার অনেক ইঙ্গিত রয়েছে। এক, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুই, উজানে (ভারত বা হিমালয় অঞ্চলে) খড় পোড়ানোর মতো চর্চা বন্ধ করতে হবে এবং সেসব বিষয়ে সীমান্ত-আলোচনায় যেতে হবে। তিন, জনগণকে নিয়ম মানতে উৎসাহিত করতে হবে। চার, ধান কাটার পর ক্ষেতের খড় পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।”
এই মন্তব্যগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে বজ্রপাত এখন শুধু প্রাকৃতিক সমস্যা নয়—এটি পরিবেশনীতি, জনসচেতনতা ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত একটি জটিল বিষয়।
আমরা কী করতে পারি?
এই গবেষণা থেকে আমাদের জন্য স্পষ্ট কিছু বার্তা আসে: ধূসর আকাশের দায় আমাদেরই: আমরা যদি ধোঁয়া ও ধূলিকণার নিয়ন্ত্রণ না করি, বজ্রপাত শুধু বাড়তেই থাকবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনা জরুরি: সীমান্তের ওপারে কৃষিজ খড় পোড়ানোর ধোঁয়াও আমাদের আকাশে বজ্র আনছে। নীতিমালা মানা ও পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা: মাঠে খড় পোড়ানো বন্ধ করতে হবে এবং বিকল্প ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে।
শেষ কথা
আকাশে গর্জে ওঠা বজ্রের আওয়াজ আমাদের জানিয়ে দেয়—পরিবেশ বিপন্ন। আর এই বিপদ কেবল প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, আমরা নিজেরাই এর বড় অংশীদার। দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা এবং প্রতিবেশী সহযোগিতা ছাড়া এই বজ্রপাত-দুর্যোগ থেকে নিস্তার নেই। এখন সময় এসেছে মেঘের আগেই ভাবার।