বাইক্কার বিলের বিরল হলদে বক

মৌলভীবাজারের বড়শিজোড়া ইকোপার্ক থেকে ফরেস্ট রেঞ্জার মুনির খান ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ তানিয়া খানের সঙ্গে ছুটে চলেছি ভারতীয় সীমান্তবর্তী আদমপুর বিটের দিকে। দেওড়াছড়া টি স্টেট পার হওয়ার পর থেকে সরু রাস্তার দুপাশের ধানখেতের দিকে তীক্ষ নজর রাখছি। না, দেখা পেলাম না। ফিরতি পথে আবারও নজরদারি। না, দেখা গেল না। পরদিন আবার ছুটলাম হাইল হাওরের দিকে। এখানেও নেই। হাইল হাওর থেকে দ্রুত ফিরে ছুটলাম বাইক্কার বিলের দিকে। রাস্তা এখনো পুরোপুরি শুকায়নি। জায়গায় জায়গায় কাদা। কাজেই সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে আইপ্যাকের বালিহাঁসের বাক্সগুলোর দিকে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটি ঢোলকলমি ও কচুরিপানায় পূর্ণ। তখন চোখে পড়ল হঠাৎ। খানিকটা উড়ে গিয়ে ঢোলকলমিগাছের নিচে বসল। পটাপট কয়েকটা ছবি তুললাম। মনটা ভরে গেল বিরল এই পাখিটি দেখে।holde bok
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে এ দেশের এক বিরল আবাসিক পাখি ‘হলদে বক’ (Yellow Bittern)। কাঠবগ বা হলুদ বগলা নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Ixobrychus sinensis।
ছোট আকারের এই বক লম্বায় ৩৬ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার। এদের গলা ছোট এবং ঠোঁট লম্বা। পুরুষের দেহের ওপরটা হলদে-বাদামি এবং নিচের রং হালকা হলুদ। ডানা হালকা হলুদ। ডানার মাঝের ও প্রান্তের পালকগুলো কালো, ওড়ার সময় যা স্পষ্ট দেখা যায়। কোমর ও লেজের পালক কালচে। মাথা ও গলা খয়েরি, মাথার টুপি কালো। ঠোঁট হলুদ। পা ও পায়ের পাতা হলদে-সবুজ। মেয়ে পাখির মাথার টুপি, গলা ও বুক বাদামি রেখাযুক্ত। বাচ্চাগুলো দেখতে মায়ের মতো হলেও দেহের নিচের দিকে বাদামি রেখার পরিমাণ বেশি। তা ছাড়া পিঠের ওপরটা হলদে ফোঁটাযুক্ত।
হলদে বক এ দেশের সব বিল ও বাদায় বাস করতে পারলেও সিলেট বিভাগের জলাধারগুলোতেই বেশি দেখা যায়। এরা নলবন, ঢোলকলমি, কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদপূর্ণ জলাধার, বিল, বাদা, খাল, পুকুর ও ধানখেতে বিচরণ করতে পছন্দ করে। একাকী চরে বেড়ায়। অত্যন্ত সাবধানী ও লাজুক পাখি। সাধারণত কোনো পাতা বা উদ্ভিদের নিচে লুকিয়ে থেকে ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ শিকার করে। এদের গায়ের রং পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বলে সহজে নজরে আসে না। কেবল ওড়ার সময়ই চোখে পড়ে। সকালে ও পড়ন্ত বিকেলে বেশি তৎপর থাকে। উচ্চ স্বরে ‘কেকের-কেকের’ বা ‘কাকাক-কাকাক’ স্বরে ডাকে।
জুন-সেপ্টেম্বর এদের প্রজননকাল। জলাশয়ের পাশের ঘন ঝোপ, কচুরিপানা, পানিতে ঝুলে পড়া উদ্ভিদ, প্লাবিত ধানগাছ—এসবে অতি গোপনে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি চার থেকে ছয়টি ফ্যাকাশে নীলচে-সবুজ ডিম পাড়ে। মা-বাবা দুজনেই ডিমে তা দেয়। ডিম থেকে ফোটার ১৫ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে।
এই বকগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধানের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ খেয়ে এরা কৃষকের বেশ উপকার করে। কিন্তু আবাস ধ্বংস এবং বিষাক্ত কীটনাশকের কারণে বিরল হলদে বকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কাজেই এদের রক্ষার জন্য সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-19/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics