বিপন্ন শুশুকেরা
শরীফ খান
১৯৬৫ সাল। ক্লাস সেভেনে পড়ি। খুলনা থেকে লঞ্চে গোপালগঞ্জের জলিলপাড়ে গিয়েছিলাম বেড়াতে। সঙ্গে সমবয়সী এক খালাতো ভাই। আমাদের বড় মামা তাঁর নববধূকে নিয়ে জলিলপাড়ের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াবেন চার-পাঁচ দিন। সঙ্গী আমরা দুই আদরের ভাগনে।
ভোর নেমেছিল মধুমতী নদীর বুকে। জলিলপাড়ে পৌঁছাই বিকেলে। ভোর থেকেই লঞ্চের ছাদের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আমরা শুশুক গণনার খেলায় মেতেছিলাম—কে বেশি দেখতে ও গুনতে পারে! আমি গুনেছিলাম ১৪৩টি, খালাতো ভাই আলম গুনেছিল ১৮৭টি (হতে পারে একটা একাধিকবার গোনা হয়েছে)।
সেই মধুমতী এখন মরে গেছে। নদী একবার মরে গেলে আর বাঁচানো যায় না। ঢাকার বুড়িগঙ্গা এখন মৃত ও পচা নদী। শুশুক ছিল একদিন এই নদীতেও। এই তো, সেদিনও ছিল!
শুশুক তথা নদীর ডলফিনরা ষাটের দশক পর্যন্ত আমাদের সব নদ-নদীতে সন্তোষজনক সংখ্যায় ছিল। এর পর থেকে কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। আগে নদী ছিল গতিময়। প্রবল স্রোত ছিল, ছিল নানা রকমের ছোট-বড় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। নদ-নদীগুলো এখন ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে। জেলেরা আগেও মাছ ধরতেন নদ-নদীতে। তখন প্রচুর মাছ ছিল। এখন নদ-নদীগুলো প্রায় মাছশূন্য, কিন্তু বুভুক্ষ জেলের সংখ্যা বেড়েছে গাণিতিক হারের চেয়েও অনেক বেশি। ছোট ছোট মাছ, যেগুলো প্রধান খাবার ছিল শুশুকের, সেগুলো উধাও প্রায়। শুশুকদের তাই প্রবল খাদ্যসংকট। উপরন্তু, জেলেদের নানা রকমের জালের বাধায় শুশুকদের যাতায়াত তথা জীবনব্যবস্থা প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। জলজ পরিবেশ আজ নষ্ট ও বিষাক্ত। এমন একটা নদ বা নদী কি আছে এখন আমাদের দেশে, যাতে শুশুক বিচরণ করতে পারে অবাধে-নিরাপদে? তার পরও আছে নানা রকমের বিপদ। জালে পড়লে জেলেরা মারেন। তেল-চর্বি নেন। ধন্বন্তরি ওষুধ নাকি হয় শুশুকের তেল-চর্বিতে!
প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় নিরীহ এই প্রাণীর ধরা পড়া, মারা যাওয়ার খবর দেখা যায়। জলের স্তন্যপায়ী এবং কিছুটা রহস্যময় এই নদীর ডলফিন টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের নদ-নদীগুলোর অনেকটা জায়গাই বরাদ্দ রাখা অতি জরুরি এখন। যান্ত্রিক জলযানের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। এসব যানের প্রপেলরের আঘাতে মারা পড়ে এরা। রাতে এরা নৌকা-জাহাজের আলোর প্রতি আকর্ষিত হয়। মাছের লোভে আলোর পিছু নেয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে নরসিংদী জেলার চরসিন্দুর এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌকার আঘাতে একটি শুশুকশাবক আহত হয়েছিল। ওটাকে উদ্ধার করেছিলেন স্থানীয় প্রাণীপ্রেমী সরওয়ার পাঠান। তিনি যখন সযত্নে ওটিকে দুই হাতে ধরেছিলেন, তখন বুক-পেটে চাপ পড়ায় শাবকটির মুখ দিয়ে সদ্য পান করা মাতৃদুগ্ধ বের হয়ে এসেছিল—দুধের রং নীলাভ সাদা। শাবকটিকে তিন দিনের চেষ্টায় সুস্থ করে জলে ছেড়ে দিয়েছিলেন সরওয়ার। সেই শাবকটির ছবিই ছাপা হলো এই লেখার সঙ্গে। এত ছোট শাবক আমি জীবনে একবারই দেখি—বাগেরহাট শহরের দড়াটানা নদীতে। ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল। তখন আমি বাগেরহাট শহরেই ছিলাম। রাতভর প্রচণ্ড ঝড় হয়। পরদিন ভোরে রহস্যময় কারণে দড়াটানার জল যেন এক চুমুকে টেনে নিয়েছিল বঙ্গোপসাগর। প্রায় শুকনো নদীর থকথকে কাদায় আটকে ছিল শুশুক-শাবকটি। দড়াটানায় আজও শুশুকের দেখা মেলে।
শুশুকের ইংরেজি নাম Ganges River Dolphin। বৈজ্ঞানিক নাম Platanista Gangetica। শরীরের মাপ সব মিলে ২১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। মূল খাদ্য এদের মাছ। গ্রীষ্ম-শরতে একটি বাচ্চা প্রসব করে। জন্মের সময় বাচ্চারা হয় ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা। মুখ-চোয়ালের গঠন তখন অনেকটাই হস্তীশাবকের সঙ্গে মিলে যায়। এদের চোখও হাতির চোখের মতোই ক্ষুদ্র। পূর্ণবয়স্ক শুশুকের ওজন হয় ৩৫ থেকে ৭০ কেজি। গর্ভধারণকাল এদের আট-নয় মাস।
সংখ্যা দ্রুত কমে এলেও এখনো শুশুকেরা টিকে আছে আমাদের দেশে। তাদের জন্য প্রতিটি নদীতেই নিরাপদ এলাকা তৈরি করা দরকার। যেখানে পড়বে না জেলেদের জাল। তোলপাড় করে ছুটবে না যান্ত্রিক জলযান। মজার প্রাণী শুশুক যে একধরনের ডলফিন, এটাও জানাতে হবে মানুষকে—বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের। ওরা ডলফিন দারুণ পছন্দ করে। প্রচুর গবেষণাও জরুরি। শুশুকদের মজার মজার অজানা তথ্য আমরা জানতে খুবই আগ্রহী। জলের ওপর ভুশ করে ভেসে ওঠে আবারও জলে ডুবে যাওয়ার কাব্যিক দৃশ্য এবং শুশুকশাবকদের মায়ের লেজে লেজে বা পিঠে পিঠে ঘোরার শৈল্পিক সৌন্দর্য যেন হারিয়ে না যায় আমাদের নদ-নদী থেকে।
http://www.prothom-alo.com/date/2013-03-18