বিরল পান্না কোকিলের সন্ধানে
আ ন ম আমিনুর রহমান
বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধানে বছর খানেক ধরে দেশের আনাচকানাচে ঘুরছি। সে কারণেই ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার মুনির আহমেদ ও তাঁর সহধর্মিণী বন্য প্রাণী ও পাখি বিশেষজ্ঞ তানিয়া খানের আমন্ত্রণ ফেলতে পারলাম না। গত ৩১ মে গিয়েছিলাম হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
সন্ধ্যায় পৌঁছে পরদিন ভোরেই দুটি বিরল পাখির সন্ধানে নেমে পড়লাম। বিকেল চারটা নাগাদ একটির সন্ধান মিলল। কিন্তু অন্যটির জন্য অপেক্ষা করতে হলো আরও দুই দিন। তবু নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। কারণ, এভাবে ‘এলাম, দেখলাম আর ক্লিক করলাম’ তো সব সময় হয় না। কোনো কোনো পাখির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
প্রথম পাখিটির কথা অন্য দিনের জন্য তোলা থাকল। আজকে দ্বিতীয়টির কথা বলছি। প্রথম দুই দিন ব্যর্থ হয়ে ৩ জুন ভোরে নাশতার আগেই জঙ্গলে ঢুকলাম। পিছু নিল উদ্যানের তিন কুকুর—লালু, কালু আর লালি। আর কুকুর নিয়ে পাখি দেখতে যাওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের এড়ানো গেল না। তবে কোনো টুঁ-শব্দটিও করল না। ওই দিন উদ্যানের বানরগুলো কেন যেন বেশ খেপে গিয়েছিল। কুকুরগুলো ওদের ভালোভাবেই সামলেছে।
পানিবিহীন শুকনা সর্পিল ছড়া ধরে এগিয়ে চলেছি। পাখি-প্রাণী-প্রজাপতি-পতঙ্গ যা চোখে পড়ছে ক্লিক করছি। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছিল না। ছড়া ধরে বহুদূর চলে এসেছি। তাই ফিরতি পথ ধরলাম। কিছুক্ষণ পর বানরগুলো পিলে চমকানো চি ৎকার দিচ্ছে। সঙ্গী কুকুর তিনটি মাঝেমধ্যে তেড়ে যাচ্ছিল বানরগুলোর দিকে। অবশ্য তাতে বানরদের চি ৎকার থামছিল না।
এমন সময় হঠা ৎই দেখা পেলাম পাখিটির। ঘন পাতা ভরা একটা গাছে পাতার আড়ালে বসে ছিল। দ্রুত ক্যামেরায় ক্লিক করে গেলাম। খানিক পর ঘন পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে পাখিটি একটা ন্যাড়া গাছে গিয়ে বসে সুরেলা কণ্ঠে গান ধরল। এটি এক বিরল পরিযায়ী কোকিল যে গ্রীষ্মে এ দেশে আসে ডিম-বাচ্চা তোলার জন্য। তবে না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা। ওর নাম ‘পান্না কোকিল’ বা ‘এশীয় সবুজাভ কোকিল’ (Asian Emerald Cuckoo)। ‘শ্যামা পাপিয়া’ নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Chrysococcyx maculatus অর্থা ৎ ‘তিলা সোনা পাপিয়া’।
কোকিল পরিবারের ছোট সদস্যদের একজন সে। লম্বায় মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী ও পুরুষের রঙে ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের পিঠের ওপরটা চকচকে পান্না-সবুজ, তাতে সোনালি-ব্রোঞ্জ আভা। থুতনি, গলা ও বুকেও তাই। বুক-পেটের নিচটা সাদা, তার ওপর ধাতব ব্রোঞ্জ-সবুজ ডোরা। লেজের নিচটা ধাতব সবুজ, তাতে সাদা ডোরা। স্ত্রীর মাথা ও ঘাড়ের পেছনটা সোনালি লাল। পিঠের পালকের রং ব্রোঞ্জ-সবুজ। গলা-বুক-পেটে সাদার ওপর বাদামি-ব্রোঞ্জ ডোরা। লেজে খয়েরি-কালো ডোরা, ডগা সাদা। চোখ ও চোখের পাতা গাঢ় লাল। ঠোঁট কমলা-হলুদ, আগা কালো। পা ও পায়ের পাতা গাঢ় বাদামি-সবুজ।
পান্না কোকিল প্রধানত চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। তবে নিচু ভূমি ও পাহাড়ের ১৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। এরা একাকী বা চার-ছয়টির দলে বিচরণ করে। গাছের মগডালে পাতার আচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকে, তাই সহজে চোখে পড়ে না। পিঁপড়া, শুঁয়োপোকা, ছারপোকা ও নরম পোকামাকড় খেতে পছন্দ করে।
এ দেশে এরা এপ্রিলের মাঝামাঝি আসে ও জুলাইয়ের শেষে চলে যায়। প্রজননের সময় পুরুষটি দিনভর ‘চিররর্-চিররর্-চিররর্-চিররর্’ স্বরে ডাকে, যা আমি রেকর্ড করেছি। আবার পূর্ণিমা রাতেও ডাকে। স্ত্রী কোকিল চুপিসারে মৌটুসি বা মাকড়সারভুকের বাসায় ডিম পাড়ে। যদিও আকারে কিছুটা বড় হয়, সাদা রঙের ডিমগুলোয় বাদামি বা লালচে ছিট থাকে। কামনা করি প্রকৃতির সৌন্দর্য এই পান্না কোকিল বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (০৫/০৭/২০১৩)