বিরল প্রজাতির পাতা-নাক চামচিকা

রেজা খান

শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বন বিশ্রামাগারে গিয়ে পৌঁছলাম কাকডাকা ভোরে। রাতভর ডাকাডাকি করে নিশাচর বুনো ব্যাঙগুলো নিদ্রাযাপনের জন্য তাদের গোপন আস্তানায় ঢুকে গেছে। আমরা কিছুটা আশাহত। বিশ্রামাগারের নিচে রেললাইন। তারপর মসজিদ। আরও সামান্য নামলে ছড়ায় ঢোকার মেঠোপথ। ব্যাঙের ডাক চৌচির করে দিচ্ছে ভোরের গাম্ভীর্য। কিছু পরিচিত প্রজাতির ব্যাঙের পাশাপাশি একটি গাছের ওপর থেকে চিৎকার করে ডাকছিল আরও একটা ব্যাঙ। বুড়ো আঙুলের চেয়ে বেশি মোটা বা লম্বা হবে না। সফরসঙ্গী ও বন্য প্রাণী গবেষক তানিয়া খান জানালেন, ওটা লাউয়াছড়ার বিশেষ একটি ব্যাঙ। নাম ‘লিটার ফ্রগ’ বা ‘আবর্জনা ব্যাঙ’। badur

আরও এগিয়ে যেতে সামনে পড়ল একটি কালভার্ট। সেটি পার না হয়ে কারও পক্ষে লাউয়াছড়ায় ঢোকা সম্ভব নয়।কালভার্টটির নিচে পৌঁছেই সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল ব্যাঙ খুঁজতে। আমি টর্চের আলো ফেলে দেখি, একটি বড় ধরনের চামচিকা খাদ্যবস্তু কুপোকাত করার চেষ্টা করছে। সফরসঙ্গীদের বললাম আমাদের মাথার ওপরের দিকে আলো ফেলতে। সে সুযোগে কয়েকটি ছবিও তুললাম।আমি ঢাকায় ফিরে আসার আগেই তানিয়া তাঁর ফেসবুকে চামচিকাটির ছবি প্রকাশ করলেন। চামচিকাটি দেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক ও প্রথিতযশা বন্য প্রাণীবিশারদ ড. মনিরুল খান সেটিকে ‘ইন্টারমিডিয়েট লিফ-নোজ্ড্ ব্যাট’ বা ‘মাঝারি পাতা-নাক চামচিকা’ বলে চিহ্নিত করলেন, যার বৈজ্ঞানিক নাম Hipposideros larvatus।              প্রথমে ১৯৮২ সালে আমার বন্য প্রাণী চেকলিস্ট এবং পরে ২০০১ সালে ভারতের জু’জ প্রিন্ট জার্নালে বাংলাদেশের বাদুড় ও চামচিকা নিয়ে লেখা আমার রচনায় দেশের চিরসবুজ ও মিশ্র-চিরসবুজ বনগুলোকে আমি এদের অবস্থান বলে উল্লেখ করেছি। লাউয়াছড়া তারই ভেতরের একটি অংশ।পাতা-নাক চামচিকাদের যে অনেকটা পাতার মতো নাক থাকে এবং তার সামনে-পেছনে যে আড়াআড়ি ও লম্বা পর্দাসহ প্রতিটি পাতা-নাকে তিনটি করে উপ বা অধ নাক-পাতা থাকে, এ গণের আর কোনো প্রজাতিতে তা নেই। এদের নাক ত্রিশূলের সঙ্গে তুলনীয়। এক চিমটি লেজ এদের পায়ের দিক থেকে আসা পর্দায় লুকানো। ৮ সেন্টিমিটার লম্বা দেহে লেজটি সহজে চোখে পড়ে না। ডানা ৬ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার। সারা দেহে বাদামি থেকে গাঢ় বা লালচে বাদামি পশম। দিনের বেলায় গুহা, গাছের ফোকর বা অন্ধকার পুল বা কালভার্টের গার্ডারে ঝুলে থাকে। রাতের বেশির ভাগ সময় এরা নিশাচর কীটপতঙ্গ, দেয়ালি পোকা ও মথ খেয়ে বেড়ায়। কখনো কখনো পরিচিত কোনো গাছের ডালে বা কালভার্টের নিচে বিশ্রাম নেয়, যেমন নিচ্ছিল আমাদের লাউয়াছড়া ভ্রমণের মুহূর্তটিতে।

পাতা-নাক চামচিকার বসতি বাংলাদেশ থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চল হয়ে একেবারে ভিয়েতনাম পর্যন্ত। বসবাস বনে। কিছুটা বিরল। আমাদের দেশে অত্যন্ত বিরল। আইইউসিএনের লাল বইয়ে এর অবস্থান ‘অবিপন্ন’ হিসেবে। দেশে প্রাকৃতিক বন যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তাতে এর ভবিষ্যৎ খুব ভালো বলে মনে হয় না।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (১৮/০৮/২০১৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics