বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে ২০,০০০ প্রজাতি; বিজ্ঞানী মহলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব!!

সাইফুর রহমান সুমন 

পৃথিবী সৃষ্টির লগ্ন থেকে আজ অবধি নানা জাতের, নানা বৈচিত্রের প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। আইইউসিএন (IUCN-International Union for Conservation of Nature) ২০০৭ এর প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রানী ও উদ্ভিদকুল মিলিয়ে ১৫ লাখেরও বেশী প্রজাতি বিদ্যমান, যাদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১০,০০০ হাজারের মত নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার হচ্ছে। অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে আরও বিপুল সংখ্যক প্রজাতি। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা ও অনুসন্ধান আমাদের শোনাচ্ছে কিছুটা নিরাশার বানী। বলা হচ্ছে যে, প্রায় ২০,০০০ প্রজাতি যারা মানুষ ও পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় তারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আসুন দেখে নেয়া যাক বিলুপ্ত পথযাত্রী কিছু জীবের করুণ কথামালা।

 এম. সঞ্জয়ন, একজন আমেরিকান গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়ার শকুণ প্রজাতি নিয়ে যিনি গবেষণা করছেন । তার ভাষ্যমতে, এই প্রজাতি ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময় থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তির কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আবাসস্থল ধ্বংস, শিকার এবং বিষাক্ত বর্জ্য বক্ষন। তবে খাঁচায় পালিত করে এদের প্রজাতির যে বিস্তরন ঘটানো হয়েছিল ১৯৯০ সালে, তার প্রায় ২০০ এর কিছু বেশী শকুন বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা এবং উত্তর মেক্সিকোতে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালের দিকে পশ্চিম আমেরিকাতে পুনরায় কিছু শকুণের আবির্ভাব ঘটেছিল। এরপর আর তেমন দেখা যায়নি। নেচার কনসারভেনসের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী সঞ্জয়ন এর মতে, শকুনের কৃত্রিম পদ্ধতিতে পুনরায় আবির্ভাব ঘটানো এদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে ফেরাতে পারে। shokun

ধূসর নেকড়ে এরকমই আরেক বিলীন হয়ে যাওয়া প্রজাতি। ১৯৭০ সালে উত্তর আমেরিকাতে এরা প্রায় সমুলে হারিয়ে যেতে বসেছিল। কারণ হিসেবে শিকারিদের অবাধ বিচরণই চিহ্নিত হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার জরিপ দ্বারা। তবে এদের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে। বর্তমানে উত্তর আমেরিকাতে এরা সংখ্যায় প্রায় ৩,৫০০। বিভিন্ন প্রানী সংরক্ষণ সংস্থা এই সমস্ত বিলুপ্ত প্রানীদের সংরক্ষণ ও প্রজননের মাধ্যমে এদের সংখ্যা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিল। wolf-gray-color-beautiful-kewl1

 আরেক বিপন্ন প্রজাতি এলিফ্যান্ট সীল; যাদের কথা না বললেই নয়। শিকারিদের গরম কাপর ও চর্বীর চাহিদার কারণে এরা সংখ্যায় ১০০ এরও নিচে নেমে গিয়েছিল। পুনঃসংরক্ষন ও প্রজননের বদৌলতে এদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১.৫ লাখ।

কিন্তু অতি পরিতাপের সাথে বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি রোধে মানুষের এই প্রাণান্তকর যুদ্ধের পরেও প্রতিদিন প্রায় এক ডজনেরও বেশী প্রজাতি প্রকৃতি থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিবাদীদের মতে, ২০,০০০ এরও বেশী উদ্ভিদ ও প্রানী প্রজাতি প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি এখন বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোন প্রজাতি ছেড়ে তারা কোন প্রজাতি রক্ষা করার ব্যাপারে নজর দিবে।

 সাম্প্রতিক সপ্তাহে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহন করেছে, যার আওতায় তারা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতি সংরক্ষন করা হবে। তানজানিয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে মিসৌরির সমতল ভুমিতে তারা তাদের এই অনুসন্ধান কাজ শুরু করবে।

এই কার্যক্রম একটি সিরিজের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।  ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এই সিরিজের নাম ‘লাস্ট অব দ্যা লাস্ট’। এই সিরিজ বিপন্ন প্রজাতি ফিরিয়ে আনার অভিযানের উপর ফোকাস করবে। কিছু মৌলিক প্রস্নানুসন্ধানও তারা করবে-যেমন, কিভাবে বিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করবে কোন প্রাণীটিকে বা উদ্ভিদ প্রজাতিকে রক্ষা করবে? এক্ষেত্রে ‘লাস্ট অব দ্যা লাস্ট’ প্রজাতি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা কিছু এলগরিদম ও লজিস্টিক্যাল মডেল ব্যাবহার করেছেন। যেমন ধরুন, x পরিমাণ ডলার যদি ডোরাকাটা পেঁচা রক্ষা করতে বিনিয়োগ করা হয় , তাহলে এটা গণনা করা সম্ভব যে কতটা প্রানী রক্ষা করা যাবে। বিজ্ঞানী ও সংরক্ষনবিদরা এব্যাপারে অগ্রাধিকার দিবেন যেসব প্রানী ও উদ্ভিদ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং যেগুলা ট্যুরিজম ব্যাবসায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। বিজ্ঞানীরা এব্যাপারে ধাঁধায় পরে গিয়েছেন যে, কিছু প্রজাতি উপকারী, কিছু প্রজাতি ক্ষতিকর, কিছু সৌন্দর্যবর্ধনকারী এবং এর বাইরেও যেগুলা আছে, তাদের কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা সংরক্ষন করবে! একটা উদাহরণ হিসেবে পিঁপড়ার কথা উল্লেখ করা যায়। পিঁপড়া পরিবেশবান্ধব, এটি মাটিতে বীজের বিন্যাসে, মাটিতে বাতাস আদান প্রদানের রাস্তা তৈরী করে দেয়, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ আহার করে উপকার করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি পাণ্ডাকে সংরক্ষন করতে যাই পিঁপড়ার পরিবর্তে; যেখানে আমাদের হাতে অনেক কারণ আছে পাণ্ডাকে পছন্দ করার ব্যাপারে যেমন- পাণ্ডা একটি আদুরে ও সুন্দর প্রানী, কিন্তু এটি যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। কারণ পিঁপড়ার সাথে উপকারী কার্যপ্রণালীর তুলনায় পাণ্ডা হয়তো পিছিয়েই থাকবে। এই বিষয়গুলো বিজ্ঞানী ও সংরক্ষনবিদদের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। last-of-the-last-graphic-flagship-species-cb1387223473

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (WWF) বিজ্ঞানী এরিক ডাইনারস্টাইন ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, পশ্চিমাঞ্চলে জরিপে বাঘ সবচেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সেক্ষেত্রে বিপন্ন বাঘ প্রজাতি সংরক্ষনের উদ্দেশে অন্য প্রানীর তুলনায় বেশী বিনিয়োগ হবে। ২০১০ সালে দ্যা ইকোনমিস্টের হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাঘ সংরক্ষণ বাবদ ৮২ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। অন্যদিকে, হাতি জনপ্রিয়তার তালিকায় বাঘের নিচে অবস্থান করছে। কিন্তু এর সংখ্যা পৃথিবীতে মাত্র ৫ লাখ। তাই এদের পিছনেও যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন পরিবেশবাদী ও সংরক্ষনবিদরা। একই সাথে বিভিন্ন মাছ ও ব্যাঙ প্রজাতিও প্রায় সমূলে বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। জ্যা-ক্রিস্টোফার, আইইউসিএন (IUCN) ডেপুটি পরিচালকের মতে, পৃথিবীতে কম বেশী মাছ ও ব্যাঙ এর ২০ প্রজাতি বিলীন হতে বাকি। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার বিলীন হওয়া বিভিন্ন মাছ প্রজাতি সংরক্ষনের নির্দেশ প্রদান করেন, যা নিঃসন্দেহে একটি কার্যকরী উদ্যোগ।

 নানা প্রাণের আধার, জীব-বৈচিত্রে ভরপুর আমাদের এই সুন্দর ধরনী। জীব বৈচিত্রের গুনেই আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি এখনো বাসযোগ্য, এতো সুন্দর এবং নিত্য নতুন সাজে প্রতিনিয়ত সজ্জিত হচ্ছে। মনুষ্য ও প্রাকৃতিক সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্রের আধার। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে  প্রতিনিয়ত । জলবায়ু পরিবর্তন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপন্ন প্রজাতির বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগই পারে পরিবেশ হতে বিভিন্ন প্রজাতি বিলীন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে। প্রজাতি সংরক্ষন তথা জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য রক্ষা, এই হোক আমাদের সকলের মূলমন্ত্র।

ন্যাশনাল  জিওগ্রাফিক অবলম্বনে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics