বিষাক্ত খাদ্যে অসুস্থতার ‘নীরব মহামারী’ চলছেঃ পবা'র সভায় বক্তারা
দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার হচ্ছে সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার। কিন্তু বিষ ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য পাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল প্রকার কাঁচা খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তরল খাবার, খাদ্য উপকরন, তৈরি খাবার, মসল্লা, খাদ্য রং, পানীয়, খাবার পানিতে বিষাক্ত পদার্থ, অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার সহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর মিশ্রণ ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মেশানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ফলে যে খাদ্য জীবন বাঁচানো ও সুস্থ থাকার জন্য গ্রহণ করা হয় সেই খাদ্যই জীবননাশ এবং অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিরাপদ খাদ্যের কারণে বর্তমানে দেশে এক ধরণের “নীরব গণহত্যা” ও অসুস্থতার “নীরব মহামারী” চলছে। এ অবস্থার দ্রুত অবসান দরকার। আজ ১৪ মার্চ ২০১৪, শুক্রবার, সকাল ১০:৩০মি. জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট (ডিএইচইএন), কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি তেল) বা বিষাক্ত রং খাদ্যে ব্যবহার এবং ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি তেল) বা বিষাক্ত রং মিশানো খাদ্য বিক্রি নিষিদ্ধ। প্রতিটি জেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় এক বা একাধিক বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপনের বিধান রয়েছে।
বিএসটিআই আইনে খাদ্যের বিদ্যমান মান বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেকেলে, বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ বা ধর্ম নির্ভর এবং উপর্যুপরি এর অধিকাংশ সাধারণ খাদ্য অন্তর্ভুক্ত নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে খাদ্য পণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণের দন্ড – মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্য পণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, কোন ব্যক্তি উক্তরূপ দ্রব্য কোন খাদ্য পণ্যের সহিত মিশ্রিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদন্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫- আইনের বিধান সাপেক্ষে, পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনের উদ্দেশ্যে মহা-পরিচালক তৎকর্তৃক সমীচীন ও প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত সকল কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবেন এবং এই আইনের অধীন তাহার দায়িত্ব সম্পাদনের উদ্দেশ্যে যে কোন ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় লিখিত নির্দেশ দিতে পারিবেন। উক্ত আইনসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী।
ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আবু সাঈদ এর সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পবার নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও হেলথ এন্ড হোপের চেয়ারম্যান ডা: লেলিন চৌধুরী, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা: মো: মোজাহেরুল হক, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সমীর রঞ্জন সমাদ্দার, ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর সাংগঠিক সম্পাদক ডা: মো: আজিজুল হক, ডা: বিলকিস বেগম চৌধুরী, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।
গোলটেবিল বৈঠক থেকে নি¤œলিখিত সুপারিশ করা হয়-
১. জাতীয় খাদ্য আইনে সংশোধনী আনতে হবে। খাদ্যে যেসব দূষণ ও ভেজাল মিশ্রণের ফলে মানুষের মৃত্যু অথবা অনিরাময়যোগ্য শারীরিক ক্ষতি হয় সেসব ভেজালকারীর জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখতে হবে। অতিদ্রুত খাদ্য আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. খাদ্যে দূষণ ও ভেজাল নিয়ন্ত্রণে রাজধানী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করণএবং এ ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন পরিদর্শন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে।
৩. জাতীয় খাদ্য আইনের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত সকল আর্ন্তজাতিক সনদ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪. খাদ্য উৎপাদন পর্যায়ে কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ কর্মসূচী গ্রহণ করা। কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত যেমন ব্লক সুপারভাইজারদের দিয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করা যায়।
৫. দেশের খাদ্য বিদেশে রপ্তানির সময় যে মান অনুসরণ করা হয় বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রেও সেই একই মান অনুসরণ করা।
৬. খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং পরিবর্তনের সাথে যুক্ত জনবলকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সনদ গ্রহণ করতে হবে। এসংক্রান্ত ব্যবসা পরিচালনার একটি পূর্বশর্ত হবে এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও পোশাক (প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গ্লাভস, মাস্ক, এ্যাপ্রন ইত্যাদি) এর বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে মেনে চলতে হবে।
৭. ভেজাল বিরোধী অভিযানের আওতায় খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতাকেও অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
৮. বিষযুক্ত ও ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহন করতে হবে।
৯. খাদ্য সংরক্ষণ, পাকানো ও স্বাদবৃদ্ধির জন্য সকল প্রকার অননুমোদিত রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, খাদ্যে টেক্সটাইল ও লেদার ডাই মিশ্রণ কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
১০. খাদ্যের আদর্শ ও সঠিকমান নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে একটি ‘স্বতন্ত্র রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার কাজ হবে সকল পর্যায়ে খাদ্যমান নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।