মানুষের জীবন এখন ব্যবসায়ীদের হাতে!!
পৃথিবীতে মানবজাতির বসবাসের সূচনালগ্ন থেকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, জীবনকে নিরাপদ করতে নিত্যনতুন উপায় বের করে চলছে আজও অবিরত। জীবন-যাত্রার শুরু হতে মানুষ অসভ্য থেকে সভ্য, পুরাতন থেকে আধুনিক আর আধুনিক হতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি আর কলাকৌশলের আবিস্কার ও তার ব্যবহার করছে কেবল এখানে অন্য প্রজাতির উপর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। প্রকৃতিতে নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে মানুষ যতই নিত্যনতুন আবিষ্কার করে চলেছে ততই পৃথিবী তার সভ্যতার চুডায় আরোহনের নতুন নতুন ধাপ এগিয়ে চলছে।আমার মতে সভ্যতার উদ্দেশ্য হবে- জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে সমস্ত মানবজাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করা। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সংজ্ঞাপরিবর্তিত হয়ে তা এখন রূপ লাভ করেছে ঠিক এমনটা – নিত্যনতুন কৌশল আর প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে মানুষের আজ্ঞাবহ করে তার যথেচ্ছব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো সভ্যতা ,যাকে এক কথায় বলা যায় বৈশ্বিক সভ্যতা। আর এই সভ্যতা নিশ্চিত করতে গিয়ে মানবসভ্যতা তার আসল সংজ্ঞাহারাতে বসেছে।
ডিনামাইট আবিষ্কার হল তেলকূপ খননে, বড় পাথর ভেঙে পথ তৈরিতে, কিন্তু তা আজ ব্যবহৃত হচ্ছে মানব জাতির ধ্বংসে। এসিড ব্যবহৃত হবে ব্যাটারিতৈরি, আকরিক নিষ্কাশন, রাসায়নিক পরীক্ষা সহ বিভিন্ন উপকারি কাজের জন্য, কিন্তু বর্তমানে এর বিশেষ ব্যবহার হল মানুষের শরীর ঝলসানো।
বহুল আলোচিত ফরমালিনের মূল ব্যবহার বিজ্ঞানাগারে জীবের নমুনা সংরক্ষণ করা। কিন্তু এটা এখন বিশেষ ভাবে পরিচিত মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণে। খাদ্য-দ্রব্যে ব্যাপক ব্যবহারের সুবাদে ছোট বড় নির্বিশেষে এর উপকারীতা আর অপকারিতা সম্পর্কে কম-বেশী জানে।ফরমালিনের এই দুইটা বিশেষ দিক আজ সমগ্রজাতিকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছে। একভাগ এর ব্যবহারে অধিক মুনাফা লাভ করে তাদের আগামীদিনের আখের গোছাচ্ছে আর অন্যভাগ তথা ভোক্তা সাধারণ এর কুফলে নানবিধ জটিল রোগে ভুগছে। আর এটাই হল চরম বাস্তবতা।
তবে এখানে যেটা লক্ষ্যণীয় তাহল, শুরুর দিকে এধরনের মানবতা বিরোধী কাজগুলো ছিল গোপন এবং বেআইনি। কিন্তু বর্তমানে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে খোলামেলা বেআইনি কার্যকলাপ। আর এটা সম্ভব হয়েছে দেশের ভুক্তভোগী সব বোকা শ্রেণীর ভোক্তাদের জন্যে। এর প্রধান কারন হল আমাদের সহনশীলতা।বিষয়টা ঠিক এরকম- ”এই যে আমি সকল ভোক্তাদেরকে বোকা বললাম তাতেও তাদের কোন কিছু যাবে আসবে না”। তবে যদি এসে যায় সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য খুবই সৎ ও স্পষ্ট, আর সেটি হলো- আমি এই বোকা শ্রেণীর ভোক্তা নই, কারণ এ বছর ভোক্তা হিসেবে আমি এখনও আম ক্রয় করিনি। কেবল পরীক্ষার জন্য বাসায় বাজার থেকে আনা আমের কয়েক পিছ খেয়েছিলাম যা আমার কাছে তিতা লেগেছিল। একবার নানার বাড়ী যাওয়ার সময় বাসে বসে আঙ্গুর খাচ্ছিলাম। এ সময় পাশে বসা এক সাংবাদিক ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি কিছুদিন আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন ফলের দোকান থেকে পনের মণের বেশী ফলমূলে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়ায় সব নষ্ট করে দিয়েছে।
আর সেই থেকে ঐ সব ফল ক্রয থেকে বিরত আছি আর পাশাপাশি অন্যকে এর ব্যপকতা ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত করে যাচ্ছি এছাড়া না হলে নয় এমন বিভিন্ন পচনশীল দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করি আর সন্দেহ হলে এড়িয়ে যাই। এছাড়া পরিচিত হলে সুন্দর বাবে জিজ্ঞাসা করি,ফরমালিন বা অন্য কোন রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়েছে কিনা। তবে এগুলোর মধ্যে টমেটোতে সন্দেহ একটু বেশীই বলতে হয়। তবে এর রঙ ও অন্যান্য বিষয় লক্ষ্য করলে কিছুটা বোঝা যায়। হ্যাঁ, এত কিছুর পরেও সব সময় যে রাসায়নিক মুক্ত জিনিস কিনছি, তা নয়। কিন্তু এটার মাধ্যমে আমার সচেতনতাটুকু অন্যকে জানাতে পারছি। যেমনটা আমার বাসায় আমি করেছি। আম খাওয়ার আগে থেকেই আমি বাসার সবাইকে জানিয়েছি যে,বিভিন্ন ফলে যে সব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে তা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর এমনকি ক্যান্সার পযন্ত হতে পারে। অতএব বাজার থেকে ফলমূল ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। এর দুই দিন পরেই বি.বি.সি. সংবাদে জানা গেল বাজারের ৯০% আমে এখন ফরমালিন ব্যবহৃত হয়। তখন এটা শুনে তাদের ভেতর অনেকটা সচেতনতার আভাস পেয়েছি। কিন্তু অবাক কাণ্ড!! এরপরও দেশের যথাযথ কতৃপক্ষের কোন মাথাব্যাথা ও উপযুক্ত পদক্ষেপ বাজারে লক্ষ্য করলাম না। যদি এমনটা হত তাহলে আমিও অনেকের মতো মজা করে আম খেতে পারতাম। তবে একটা আমের পুরোটা খেয়েছি যা আমার বাপের বন্ধু দিয়েছিলেন, সেই সুদুর বরিশাল থেকে আনা গ্রামের বাড়ির আম।
কিন্তু বর্তমানে আম খাওয়ার বিষয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। মাথাব্যাথা কেবল কিভাবে মানুষকে আম সহ অন্যান্য খাবার থেকে বিরত রাখা যায় যেটি না খেলেও আমরা বেচেঁ থাকতে পারি সে বিষয়ে। কারন, এ খবরটি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পরও আমরা এগুলো খেয়েই যাচ্ছি কিন্তু ভবিষ্যতে এর ফলে আমাদেরকেই যে অনেক মূল্য দিতে হবে সে বিষয়ে আমরা চরম উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছি।আর এই সুযোগে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা তাদের অধিক মুনাফা লাভের জন্য নির্লজ্জ ও নগ্নভাবে আমাদেরকে নির্বোধ পশুর মতো ব্যবহার করে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে মানুষের বিচার বুদ্ধির সাথে ঐ সব প্রকৃত নির্বোধ পশুর সাথে তুলনা করলেও মানুষের অবস্থান কোন ভাবেই উপরে তা বলা যাবে না, কারণ তাদের অজান্তে কোন অখাদ্য যুক্ত করে দিলেও তাদের নিজেদের শারীরের স্নায়ুবিক ব্যবসস্থার মাধ্যমে সে সব খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে যেমনটা দেখা যায় গরু-ছাগলের ক্ষেত্রে, কেননা ঘাস, তরু-লতা খাওয়ার সময় তারা বিষাক্ত খাবার গ্রহণ এড়িয়ে চলে। কিন্তু মানুষের এত উচ্চ মাত্রার বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকার পরও জেনে শুনেই ফরমালিন যুক্ত ফলমূল খেয়েই চলেছ!
আজ বাজারের দিকে লক্ষ্য করুন, দেখবেন এক বিক্রেতা ব্যানার লাগিয়ে কেমিক্যাল মুক্ত বলে ফল বিক্রি করছে আর অন্যজন ব্যানার ছাড়াই বিক্রিকরছে, মনে হচ্ছে সে জবাব দিহিতার অনেক ঊর্ধ্বে। তবে জিজ্ঞেস করলে বলবে সে ও কেমিক্যাল মুক্ত। তবে দুশ্চিন্তা হল- সেই খবরে এটাও বলা হয়েছিল যে, সব দোকানে ব্যানার ঝুলানো ছিল সে সব দোকানের ফলেও বিষাক্ত কেমিক্যাল পাওয়া গিয়েছিল।
পরিশেষে বলব, আজ প্রশাসনের উদাসীনতার সুযোগে একজোট হয়ে এ সব অসাধু ব্যবসায়ীরা যদি অন্যায় ও নির্লজ্জভাবে মানুষ ও অন্যান্য জীবের খাদ্যে বিষ মেশাতে পারে তবে আমরাও ইচ্ছা করলে পারি এ সব ব্যবসায়ী নামধারী নির্লজ্জ, কুলাঙ্গার, মানবতা বিবর্জিত ও সমাজের শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এ সমস্ত দ্রব্য ক্রয় থেকে বিরত থেকে তাদের ব্যবসার বারোটা বাজাতে। মাত্র একটি বছর আমরা এ সব পণ্য ক্রয় বর্জন করলেই দেখবেন এই মানুষ রূপী বানরগুলো আবার বির্বতনের মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠেছে।
মেহেদী হাছান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ফার্মেসী বিভাগ