মান্দারিন হাঁস

মান্দারিন হাঁস (Aix galericulata) (ইংরেজি: Mandarin Duck) বা সুন্দরী হাঁস  অ্যানাটিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত অ্যাক্স গণের এক প্রজাতির বাহারি রঙের ছোট ডুবুরি হাঁস। মান্দারিন হাঁসের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ টোপরপড়া ডুবুরি (গ্রিক aix = ডুবুরি পাখি; ল্যাটিন galericulata = টোপর)। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা কমে গেলেও আশংকাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছায় নি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা ন্যুনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি । বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত নয়।

Aix_galericulata_-_Zürich_-_Hafen_Riesbach_2011-01-14_15-58-32পুরুষ মান্দারিন হাঁস অসাধারণ সুন্দর, রঙ-চঙে এক হাঁস। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৪ সেন্টিমিটার, ডানা ২২.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.৮ সেন্টিমিটার, পা ৩.৮ সেন্টিমিটার ও লেজ ১১ সেন্টিমিটার। ওজন ৪২৮ থেকে ৬৯৩ গ্রাম। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ও পুরুষ হাঁসের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।পুরুষ মান্দারিন হাঁসের সারা শরীর জুড়ে নানান রঙের ছড়াছড়ি। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ হাঁসের ডানা কমলা রঙ ধারণ করে, ডানায় নৌকার পালের মত দু’টি খাড়া পালক থাকে। মাথা গোল, মাথার চাঁদি বাদামি, চাঁদির সামনের দিকটা নীলচে সবুজ। চোখের উপর চওড়া সাদা ছিটা-দাগ, সাদা মোটা ভ্রু ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। গলা, ঘাড় ও চিবুক কমলা রঙের ঘন ঝালরের মত পালকে আবৃত। ঘাড়ের ও গলার বাকি অংশ ঘন নীলচে পালকে আবৃত। ডানার গোড়ায় কালো-সাদা বলয় থাকে। ডানা হালকা পাটকিলে বর্ণের। দেহতল সাদা। পিঠ,লেজ ও ডানার প্রান্তভাগের পালকগুলো কালো। ঠোঁট পীচ ফলের মত লাল, ঠোঁটের অগ্রভাগ হালকা গোলাপী। চোখ ঘন বাদামি। পা কমলা-পীতাভ বর্ণের আর লিপ্তপাদ। পায়ের পর্দাগুলো কালো। প্রজনন ঋতু ব্যতীত অন্যান্য সময়ে পুরুষ হাঁস পুরোপুরি স্ত্রী হাঁসের মত। কেবল পিঠ চকচকে আর ঠোঁট লালচে থাকে। স্ত্রী মান্দারিনের আবার এত রঙের বাহার নেই, বেশ সাদামাটা। স্ত্রী হাঁসের পিঠ জলপাই-বাদামি, দেহতল সাদা। বগলের উপর সারি সারি সাদা ফুটফুটে দাগ। বুকে অনেকগুলো সাদা রেখা দেখা যায়। ডানার মাথার পালকগুলো নীল, তার উপর সাদা ছোপযুক্ত। স্ত্রী হাঁসের চোখে সাদা “চশমা” থাকে, চক্ষু-রেখা সাদা। ঠোঁট হলদে। এমনিতে চোখ আর পা পুরুষ হাঁসের মতোই। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের চেহারা প্রায় স্ত্রী হাঁসের মত, তবে মাথা বাদামি আর বুকে ও বগলে বিচ্ছিন্ন সাদা ফোঁটা থাকে।

মান্দারিন হাঁস মিঠাপানির আর্দ্রভূমি, প্লাবিত ধানক্ষেত, বনের জলধারা, পুকুর, হ্রদ ও তৃণময় জলাশয়ে বিচরণ করে। যেসব জলাশয়ের ধারেকাছে ঘন বন থাকে সেসব জলাশয় এদের পছন্দের জায়গা। সাধারণত অন্যসব প্রজাতির হাঁসের মিশ্র ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। এরা সামাজিক হলেও পুরুষ হাঁসেরা সচরাচর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এরা ভাল সাঁতারু ও দ্রুত উড়তে পারে, তবে ডুব দিতে পটু নয়। ঊষা আর গোধূলিবেলায় বেশি কর্মপটু থাকে। দিনের অন্য সময়ে ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের পা যেখানে শরীরের পেছনে অবস্থিত, সেখানে মান্দারিন হাঁসের পা তুলনামূলক সামনে অবস্থিত। সেকারণে এরা ডাঙাতেও সচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে। এই সুবিধার জন্য এরা গাছের ডালেও বসতে পারে। বন্দী অবস্থায় এরা সহজেই ৬-৭ বছর বাঁচে, সর্বোচ্চ বাঁচে ১০ বছর পর্যন্ত।

মান্দারিন হাঁস অগভীর জলে মাথা ডুবিয়ে ঘাস ও লতাপাতা থেকে খাবার সংগ্রহ করে। এরা রাতেও খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ উদ্ভিদ, শস্যদানা (বিশেষত ধান), ছোট মাছ, শামুক, কেঁচো, জলজ পোকামাকড়, চিংড়ি ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী এমনকি ছোট সাপ।

মে থেকে আগস্ট মান্দারিন হাঁসের প্রজনন ঋতু। এ সময় এদের ডাকাডাকি বেড়ে যায়। পুরুষ হাঁস স্ত্রী হাঁসের মনোরঞ্জনের জন্য এক ধরণের নাচ প্রদর্শন করে। পুরুষ হাঁস ঘাড় লম্বা করে মাথা উপর-নীচ করতে থাকে এবং এক ধরণের মৃদু শব্দ করতে থাকে যা অনেকটা ঢেকুরের মত শোনায়। এছাড়া স্ত্রী হাঁসের পেছনে পেছনে ভেসে বেড়ানোর সময় পানি পানের ভান করে আর শরীর ঝাঁকায়।ঘন বনের মধ্যে জলাশয়ের কাছাকাছি এরা বাসা করে। সাধারণত গুহায়, গর্তে বা গাছের কোটরে ঘাস, উদ্ভিদাংশ ও পালক বিছিয়ে বাসা করে। বাসার উচ্চতা মাটি থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচুতে হয়। মূলত স্ত্রী হাঁসই বাসা বানাবার জায়গা পছন্দ করে আর বাসা বানায়। পুরুষ হাঁস এ ব্যাপারে স্ত্রী হাঁসকে সহায়তা করে।সাধারণত একবারে ৯-১২টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ রঙের হয়। ডিমের মাপ ৪.৯ × ৩.৬ সেন্টিমিটার। কেবল স্ত্রী হাঁস ডিমে তা দেয়। পুরুষ মান্দারিন এসময় আশেপাশেই থাকে আর বাসা পাহারা দেয়। ডিম ফোটার সময় হলে পুরুষ হাঁস দূরে চলে যায়। শিকারী প্রাণী বাসার কাছাকাছি এলে মা হাঁস ডেকে ডেকে তাদের দূরে সরিয়ে নেয়। ২৮-৩০ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সব ডিম ফুটে যায়। ডিম ফোটা শেষ হলে মা হাঁস মাটি থেকে ছানাদের নেমে আসার জন্য ডাক দেয়। কোটর বা গর্ত থেকে ছানারা শূন্যে ঝাঁপ দেয় আর আশ্চর্যজনক ভাবে কোন রকম গুরুতর আঘাত ছাড়াই নিরাপদে মাটিতে নেমে আসে আর মায়ের পিছু পিছু কাছাকাছি জলাশয়ে যেয়ে নামে। এসময় পুরুষ মান্দারিন ফিরে এসে ছানা আর স্ত্রী হাঁসের সাথে মিলিত হয়। ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ছানারা উড়তে শেখে আর নতুন ঝাঁকে যেয়ে যোগ দেয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics