লাউয়াছড়ার সাপ
এখন থেকে ১৫ মিনিট আগেও সিদ্ধান্ত ছিল ‘যাচ্ছি না’ বিছানার উষ্ণতায় আগের দু’দিনের ঠান্ডা আর জ্বরের হিসেব নিকেশ বার বার ফোনের ৫.৪০ এর আ্যালার্মটিকে স্নুজ করে দিতে বাধ্য করছিল। শেষমেশ আলস্য, অসুস্থতার সেটব্যাক ডিঙিয়েই সি.এন.জি-তে চেপে বসলাম। গন্তব্যের উদ্দেশ্য সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, সেখান থেকে শ্রীমঙ্গল>লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বন্দর, কীন ব্রিজ পার হতে হতেই টের পেলাম সকালের ট্রেনটা বোধ হয় মিস করে ফেলেছি। সময় নষ্ট না করে দ্রুত হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসে চেপে বসি শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
টিকেটের দাম আশি টাকা, প্রতি ঘন্টায়ই একাধিক বাস ছাড়ে। সকালের জার্নিটাও আবহাওয়ার জন্য খুব উপভোগ্য ছিল। রমজানের জন্য সকালের বাসে যাত্রী বলতে আমি সহ পাঁচজন, যা মৌলভীবাজার পর্যন্ত প্রায় একই ছিল। বিভিন্ন যায়গায় যাত্রীর জন্য বেশ দেরী করতে হচ্ছিল। এদিকে চিন্তা করতে হচ্ছিল যেহেতু রওনা দেবার আগে ক্যাম্পে জানাতে পারিনি। তাদের ৯টার মধ্যেই ফিল্ডে নেমে যাবার কথা। জায়গায় যায়গায় দেরী হলেও ফাঁকা রাস্তায় বাস চলছিল দ্রুত। সকাল ৯টায়ই শ্রীমঙ্গল পৌঁছে ফোন দিই ফরেস্টের ফুলবারি ক্যাম্প সংলগ্ন নিসর্গের স্টুডেন্টস ডর্মে অবস্থানকারী গবেষক সরিসৃপবিদ সীজার রহমানকে। আস্বস্ত হলাম তারা তৈরী হচ্ছেন জেনে। সি.এন.জি-তে ভানুগাছের লোকাল ভাড়া ২৫ টাকা ঠিক করে রওনা দিলাম।
ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম মিনিট বিশেকের মধ্য। আগেও এসেছি কিন্তু থাকা হয়নি কখনো। রাস্তা থেকে দক্ষিণে বেশ কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত ‘প্রকৃতি জীবন’ হল নিসর্গ প্রজেক্টের স্টুডেন্ট’স ডর্মিটরী। অদ্ভুত সুন্দর সবুজ টিলার মাঝে ডর্মটি একটি কোর্টইয়ার্ড-সেন্টারড একতলা ভবন। রেসিডেন্ট গবেষক আর ছাত্রদের জন্য খুব সুবিধাজনক ক্যাম্পিং স্পট। ভেতরে ঢুকতেই স্বাগতম জনালেন সীজার রহমান। সপ্তম শ্রেণীতে আমেরিকা চলে যান। পড়াশোনা করেছেন সিটি ইউনিভার্সিটি নিউ ইয়র্কের মেম্বার ব্রুকলিন কলেজে ইকোলজি বিষয়ে। কলোরাডো, আ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো জায়গায় কাজ করেছেন সরিসৃপ, বিশেষ করে র্যাটেলস্নেক নিয়ে। সাথে অন্যান্য প্রাণী তো আছেই। তার সাথে পরিচয় ফেসবুকে নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে। বাংলাদেশে এসেছেন এখানকার এখনো এনেকটা আন-এক্সপ্লোরড এবং অসম্ভব বৈচিত্রময় সরিসৃপজগত নিয়ে কাজ করতে। মোর্তুজা চাচার আনা রুটি আর কলা দিয়ে নাশতা করতে করতে জানলাম তার কাজ সম্পর্কে। টেবিলে ছড়ানো ছেটানো বিভিন্ন ফিল্ড গাইড আর হার্পেটোলজির বই এর মাঝে উনি ডাটা এন্ট্রির কাজ বোঝাচ্ছিলেন ফিল্ড আ্যাসিসট্যান্ট নিখিলদাকে। পাশেই টঙ্গ (সাপ হ্যান্ডল করবার ইন্সট্রুমেন্ট), গ্লাভস আর রসদ নিয়ে ব্যাগপ্যাক রেডি করছিল কানাইদা। সীজার ভাইয়ার পার্মানেন্ট টীমের সদস্য উনি সহ এই মোট পাঁচজন। পষ্ণম মেম্বারের সাথেও দেখা হয়ে গেল টেবিলে বসেই। লালী, চাচার বাসার (ক্যাম্পের কাছেই) পাহারাদার কুকুর, টীমের সামনে থেকেই সাপ ধরায় সাহায্য করে থাকে। লালীর সঙ্গী টাইগারও ডর্ম পাহাড়া দেয় রাত্রে। সীজার ভাইয়া বলছিলেন তার কাজের কথা। আমি আসার আগেই তারা ২৭ প্রজাতির প্রায় ৭০টি সাপ ক্যাপচার করেছিলেন। যার মাঝে বাংলাদেশের জন্য নতুন দুটি প্রজাতির সাইটিং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দু:খের বিষয় এর মাঝে একটির জীবিত স্পেসিমেন তারা পাননি, পেয়েছেন রোডকিল। ফরেস্টে, পাশের ফুলবাড়ির বিশাল চা বাগানে আর আশেপাশের গ্রামে বাড়িতে কিম্বা পুকুর দুটো টীমে বিভক্ত হয়ে তারা সাপ সংগ্রহ করেন। মাঝে অনেকে ভলানটিয়ার করতে আসেন, তা না হলে কানাইদা, নিখিলদা একসাথে আর চাচা, লালী সহ সীজার ভাইয়া সাধারণত ফিল্ডে যান সাপের খোঁজে। উদ্দেশ্য খুব কম কাজ হওয়া আমাদের সরিসৃপজগতের ডাইভার্সিটি এক্সপ্লোর করা, বিশেষ করে লাউয়াছড়ার পাইথন নিয়ে কাজ করা। এজন্য প্রথম কাজ সাপ সংগ্রহ যা খুব পরিশ্রম আর ধৈর্য্যের কাজ। একই সাথে তা বিপদজনকও। চাচা ছিলেন বন বিভাগ নিসর্গের গাইড আর ডর্মের একজন কেয়ারটেকার। নিখিল আর কানাই চা বাগানে কাজ করে আর নিসর্গ কিংবা কোন গবেষকের প্রয়োজনে ফিল্ডেও কাজ করে। বেশ কয়েক মাসে ভাইয়ার তত্বাবধানে আর সেফটি ইকুইপমেন্ট এর সুবাদে তারা বেশ পরিণত স্নেক হ্যান্ডলার হয়ে উঠেছে। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম লাউয়াছড়ায় সাপের বৈচিত্র এখনও অনেক অবাক করা যদিও সাপের আবাস এখানে দিনকে-দিন নষ্ট হচ্ছে বনদস্যু আর খোদ বনবিভাগের কারণে। ডর্মে আসার ৭ কিলো রাস্তাও সাপ, ব্যাঙ আর গিরগিটির জন্য হুমকী স্বরূপ। ইতোমধ্যে চা-বাগানের দিকে রওনা দিতে কানাই-নিখিলদা বিদায় নিল। বলে রাখা দরকার সিলেটের চা বাগান গুলো সাপ পাবার ভালো একটি মাইক্রোহ্যাবিট্যাট যদিও সারাদিনে একটিও সাপ পাওয়া (ফরেস্ট হোক, বাগান হোক) সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার। সাপ ধরে কাপড়ের ব্যাগে করে নিয়ে আসা হয় ক্যাম্পে। এখানে চলে সায়েন্টিফিক মাপ-জোক, সাপের নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, বিভিন্ন দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (Snout-Vent, Vent-Tail, Head), পাবার স্থান, মা্ইক্রোক্লাইমেট, সেক্স নির্ণয় করে লিপিবদ্ধ করা হয়। এর সাথে একে একটি নির্দিষ্ট আই.ডি দিয়ে দেয়া হয় এবং সাপটিকে পরবর্তী আউটিং এর সময় এর উপযুক্ত হ্যাবিট্যাটে ছেড়ে দেয়া হয়। এতে কিছুদিন পর যদি আবা
র, বারবার এরা ধরা পড়ে, আইডি দেখে আগের ড্যাটার সাথে তুলনা করে এর স্বাস্থ্য, বেড়ে ওঠা, চলাচল ইত্যাদি সম্পর্কে সুন্দর ধারণা পাওয়া যায়। সীজার ভাইয়ার ড্যাটাবেস থেকে দেখলাম অপরূপ কিছু সাপের ছবি। চিকন মাথা লাউডগা সাপ (Short Nosed Vine Snake), সবুজ টিয়া বোরা সাপ (White-Lipped Pit Viper), Striped Keelback (চিলু সাপ), দেশে নতুন পাওয়া Himalayan Keelback আর Iridescent Snake, সবুজ ফণিমনসা সাপ (Green Cat Snake), অজগর বা ময়াল (Burmese/Rock Python), ঘরগিন্নী সাপ (Common Wolf Snake), দুধরাজ সাপ (Copper-headed Trinket Snake), বনকরাজ সাপ (White Barred Kukri Snake), বাদামী গেছো সাপ (Bronzeback Tree Snake) সহ আরো অনেক সাপ। আমি আসার আগে পাওয়া অধিকাংশ সাপই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সেসময় থাকা ৬টি পাইনা/হুরিয়া সাপ (কমন স্মুথ ওয়াটার স্নেক) একটি সংরক্ষণ পাত্র এনে আমরা সাপগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম আর ডাটা এন্ট্রি করলাম। ইতোমধ্যে আমাদের দেখতে আসলেন ডর্মের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রজেক্টের নজরুল সাহেব। পাঁচটি সাপের ডাটা শেষ করেই চাচার আনা একটি খবরের ভিত্তিতে আমরা ভানুগাছ রওনা দিলাম, ক্যাম্প থেকে সিএনজিতে পাঁচ মিনিটের পথ। ওখানকার এক ব্যক্তিগত পুকুরের অর্ধেকে আগের দিন মাছ ধরা হয়েছিল। সরানো কচুরিপানার কাদায় আর মাছ ধরার জালে আটকা পড়েছিল আমাদের আইডি করা পাইনা সাপগুলো। ওখানে যাওয়া পুকুরে বাকিটুকু মাছ ধরার সংবাদের ভিত্তিতে। তবে ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে সেদিন আর মাছ ধরা হয়না এবং আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি।
দুপুরে চাচার বাসার অপূর্ব রান্না খেয়ে আমরা রোডকিল নিয়ে কথা বলতে থাকি। চাচার (এটি অন্য আরেক চাচা) দোকান থেকে মূলত ফরেস্টের শুরু। এখান থেকে ফুলবাড়ি ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। আঁকা-বাঁকা রাস্তা মাত্র ১২ফুটের মত প্রসস্ত (যা ৫ ফুটের মত বাড়ানোর জন্য ইটের আ্যাগ্রেগেট ফেলা আছে, এখনো পাকা করা হয়নি)। মাঝামাঝি জায়গায় লাউয়াছড়া বীটের গেট (যেটা মূল ট্যুরিস্ট স্পটের প্রবেশ)। ৭ কিলোর পুরোটাতেই সিএনজি, জীপ, মিনিবাস আর ট্রাক যাতায়াত করে ভানুগাছ, শমশেরনগর পর্যন্ত। রাস্তায় একটিও স্পিড ব্রেকার নেই। গাড়ি চলাচল করে ‘বেপরোয়া’ ভাবে (শব্দটি বিশেষণটিকে বর্ণনা করতে ব্যর্থ; Crazy/Madness বললে বোধহয় কিছুটা বোঝা যায়)। মোড় ঘোরার সময়ও গাড়ির গতি তেমন কমেনা এবং এসময় পাশাপাশি ক্রসিংয়ের সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা হবার সম্ভাবনা থাকে। ফরেস্টের শুরুতে একটিমাত্র সাইন আছে সাবধানে গাড়ি চালাবার জন্য, বন্যপ্রাণী প্রায়শই রাস্তা পারাপার করে। ফলে প্রতিদিন মারা পড়ছে এরা নির্বিচারে। বাইরের দেশগুলোতে খুব গুরুত্বের সহকারে দেখা হলেও এই ‘রোডকিল’ বিষয়টি এখানে একদমই তোয়াক্কা করা হয়না। ফলে ৭ কিলোমিটারে দিনে গড়ে তিন থেকে সাতটি সাপ, ১০ বা ততোধিক ব্যাঙ, গিরগিটি, কেঁচো মারা পড়ছে। দিনে ৫টি করে হলে সে হিসেবে বছরে প্রায় ১৮০০ সাপ! যা রীতিমত আশঙ্কাজনক একটি তথ্য। তথ্যগুলো ওখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং প্রতিদিন বিকেলে ফরেস্টের ভেতরের এই রাস্তায় চাচার দোকান পর্যন্ত ২ঘন্টা পায়ে হেঁটে রোডকিল সার্ভে করা হয়। রেইনফরেস্টে স্বভাবতই বৃষ্টিপাত অনেক বেশি। ফলে রোডকিল স্পট করা বেশ কষ্টকর। আমি আর সীজার ভাইয়া বিকেল চারটা নাগাদ ক্যাম্প থেকে হাঁটা শুরু করলাম ফরেস্টের অপর প্রান্তের উদ্দেশ্য। হাঁটতে হাঁটতে বিবিধ বিষয় নিয়ে কথা হল। রোডকিল কমিয়ে আনার উপায় নিয়েও বিস্তর আলোচনা হল। দু’জনে মিলে ৪টি সাপ স্পট করলাম রাস্তায় গাড়ির চাপায় মৃত অবস্থায় যার বেশিরভাগ মক ভাইপার আর ছোট্ট সুতানলী সাপ (Blind Snake)। অপর প্রান্তে পৌঁছাতে সাড়ে ছয়টা বেজে গেল, অন্ধকার হয়ে আসলো। চা খেয়ে আমরা বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম সিএনজির জন্য। যেতে যেতে আবারও বেপরোয়া গতির গাড়ি চালানো উপলব্ধি করলাম হল। ক্যাম্পে ফিরে আলাপচারিতা শেষ করে রাতের খাওয়া শেষ করতে করতে চাচার মুখে ময়নার বাসা, শকুনের বিলুপ্তির কথা শুনছিলাম। শুনিছিলাম দুধরাজ সাপের গরুর দুধ খাবার গল্প আর টিয়াবোরা সাপের চা বাগানে থাকার কারণ। গ্রামের লোকজন এখন কিছুটা সচেতন। টীমের কাজের খবর তারা জানে। মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে খবর আসে বিশেষ করে গোখরা/খরিশ সাপের। গ্রামে গিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা হয়। আসলে গোলা/গুদামের ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ ইত্যাদি সহজলভ্য খাবার জন্য মানুষের আবাসের কাছ সাপেরা চলে আসে। ইঁদুর খেয়ে উপকারও করে কিন্তু একই সময় মানুষের সাথে কনফ্লিক্টে জড়িয়ে পড়ে। সাপের আক্রমণ নিতান্তই একটি ডিফেন্স মেকানিজম। সুযোগ পেলে তারা পালিয়ে বাঁচে। রুম বুঝে নিয়ে বারোটা নাগাদ ঘুমনোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। তখন মাত্র ভোর হচ্ছে। অদ্ভুত একটি লাল আভা পেছনের জঙ্গলময় টিলার পেছন দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। অপরিচিত পাখির ডাকের ভোরটা সত্যিই কখনো ভোলার মত না। বিছানা ছেড়ে জনালা গুলো খুলে দিয়ে সিজার ভাইয়ার Nikon বাইনোকুলারটা নিয়ে বিছানায় বসেই বার্ডিং শুরু করলাম। দেখলাম টিলার নিচে পাকা শিকারী লাল বকের মাছ ধরার জন্য প্রচন্ড ধৈর্য। পাতা বুলবুলি (লিফ বার্ড), কেশরাজ (Spangled Drongo), আলতাপরী (Scarlet Minivet), মোচাটুনী (Spider Hunter), ভাদাটুনী (Abbott’s Babbler) ও অন্যান্য ব্যাবলার, মাছরাঙা, ঘুঘু সহ প্রায় ১৫ রকম পাখিতে মুগ্ধ হতে পারলাম বিছানা থেকেই! মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে নিলাম আমরা। আগের দিন নিখিল-কানাই অল্পের জন্য একটি দারাশ (Indian Rat Snake) হাতছাড়া করে খালি হাতে ফিরে আসে। আজকে আমরা দুটো টীম যাব ফুলবাড়ি চা বাগানের ভেতরে। আমরা ছয়জন ফিল্ডের জন্য রেডি হয়ে নিলাম আর রওনা দিলাম। ক্যাম্পের পাশেই ফুলবাড়ির চা বাগান। আমরা এর কানেকটিং রোড ধরে দক্ষিণে হাঁটতে লাগলাম। ব্রিটিশ বাংলো স্টাইলের একেকটি স্ট্রাকচার কলোনিয়াল দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়। বাগান স্থানীয় কমিউনিটির জন্য তৈরী করে দিয়েছে স্কুল, মসজিদ, চার্চ আর মন্দির। কাজ যারা করে তারা আশেপাশের গ্রামেই থাকে। ভাষায় বিহারী নয় ঝাড়খন্ডের একটা টান আছে, তবে মোটেই সিলেটী নয়। প্রথমে আমরা গেলাম গ্রামের একটি বাড়িতে যারা আগের দিন কানাইদের মোবাইলে তোলা ছবি দেখিয়েছিল একটা সাপের যে কীনা তাদের বাড়িতে বশ কিছুদিন ধরে অবস্থান করছে। ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল সাপটি গোখরা। সীজার ভাই আর নিখিল ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বাড়ির পেছনের উঁচু জায়গা আর পরত্যাক্ত কিছু কাঠের মাঝে ২০মিনিটের মতো অনুসন্ধান চালালো। সবাই উৎসাহ নিয়ে আমাদের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগলো। আমিও আগ্রহ নিয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর আর সাপ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে জানালাম। অগত্যা বাড়ির সবার কাছে বিদায় চেয়ে আমরা আবার বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। সাথে থেকে লালীও শিখে গেছে সাপ খোঁজা। সীজার ভাই বললেন ও মাঝেমাঝেই সাপকে সুবিধাজনক দিকে তাড়া করে নিয়ে আসে আর সাপের অবস্থান জানিয়ে দেয়। চা বাগানের দৃশ্য ফরেস্টের চাইতে কোন অংশে কম নয়। লম্বা গাছ হয়ে ওঠে পাখির জন্য পার্চিং সাইট। দেখলাম লালবুক টিয়া, সাপখাউরি ঈগল, ধোপা জঙ্গল, বড় আমতোতা পাখি। আর চা বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার ব্যাঙের জন্য এগুলোতে আসে সাপ। বিশেষ করে টিয়াবোরা, মক ভাইপার আর খরিশ গোখরা। চা বাগানে গেলে কাজ করতে করতে শ্রমিকেরা প্রতিদিনই সাপ দেখে এবং ব্লক পরিবর্তন করে কাজ করে। আমরাও কাজের একটি ব্লকের পাশেই স্পট ঠিক করে সাপ খোঁজা শুরু করলাম। সবার হাতে প্রতিরক্ষামূলক গ্লাভস, টঙ আর পায়ে বুট। ২ ঘন্টার মতো সার্চ করে চাচা আর সীজার ভাইয়া ফিরে এলো আর বাকি দুজন সাপ দেখার তথ্যের ভিত্তিতে পাশের ব্লকে চলে গেল। আমরা এগিয়ে গেলাম আর ছায়ায় জিড়িয়ে নিলাম। পচন্ড গরমে সবাই তখন হাঁপাচ্ছি। ব্যাকপ্যাকে নেয়া স্যালাইন ওয়াটার খেয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকীদের। ওরাও ফিরে আসে খালি হাতে। তবে সীজার ভাইয়া হতাশ হন না। তার মতে “Most of the days are like this”। আমি আর সীজার ভাইয়া দুটোর মধ্য ফিরে যাই এবং বাসায় ফিরেই ভাল সংবাদ পাই। ক্যাম্পের একজন আমাদের জন্য একটি চিলু সাপ (স্ট্রাইপড কীলব্যাক) ধরে রেখেছিল। সাপটাকে বের করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা হল। বিষ নেই এবং খুব কমন একটি সাপ। সীজার ভাইয়া বললেন, কমন স্পিশিজ এর স্টাডি বেশি প্রয়োজন। তাদের পপুলেশনের অবস্থা পুরো হ্যাবিট্যাটের অবস্থার ইঙ্গিতবাহক।
দুপুরের খাবার মুরগী আর কাঁঠালের বীজ দিয়ে রান্না করা ডাল খেলাম আমরা। বিকেলের রোডকিলের হাঁটার সাথে আমার ফিরেযাওয়াটাও ছিল। তা্ই একবারে গুছিয়ে নিয়ে আবার চারটে নাগাদ রওনা দিলাম আমরা। বৃষ্টি ছিল তাই প্রচুর ব্যাঙ পাচ্ছিলাম আমরা। একটা ‘ডেথ জোনে’ আমি পেলাম একটা মক ভাইপার। (ওদের এধরণের নাম হবার কারণ হল, ওরা ভাইপার না, বিষধরও না অথচ দেখতে ভাইপারের মত ত্রিকোণাকার মাথা ওয়ালা, ঠিক যেন ভাইপারদের ‘মক’ করে নিজেকে বিষধর দেখানোর জন্য। এটিও ওকটি ডিফেন্স মেকানিজম) এগোতে লাগলাম আমরা লাউয়াছড়ার ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে বলতে। বড় গাছ বিশেষ করে সেগুন এখন আমরা হাতেই গুনতে পারবো। শত শত প্রজাতি এই প্রাচীন গাছগুলো হারালে আবাস হারাবে। গাছ চুরি ঠেকাতে উদ্যোগের অভাব অনেক পুরনো অভিযোগ। প্ল্যান্ট ডাইভার্সিটি স্টাডি করে উপযুক্ত গাছ না লাগানোটা বন বিভাগের মূঢ়তারই পরিচায়ক। শেভরনের সাইট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে তবে ভাইয়ার কথা হল যে আমরা নিজেরা যে হারে বনের সম্পদের অমর্যাদা করি সেখানে বাইরের দেশের একটি সংস্থা এসে লুটপাট করবেনা কেন? বনে বেড়াতে আসলে জোরে মিউজিক বাজাই আমরা, বোকার মতো ‘বানর কই, ঝরনা কই, কিচ্ছু নাই’ মানশিকতা নিয়ে আমরা ফরেস্টে পিকনিকে আসি। ট্যুরিসম আর কো-ম্যানেজমেন্টের নামে বনের যতোটুকু ক্ষতি হয়েছে, যতোটা সম্ভব পুষিয়ে নেয়া। আমরা চলে আসি বীট অফিস গেটের আগে রাস্তার একটি নির্দিষ্ট প্যাচ-এ। জায়গাটি আমাদের দু’জনেরি খুব প্রিয়। অনেক প্রাচীন সময়কার বন এটা এই জায়গায় তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। বিশাল সেগুন গাছগুলোর দিকে নির্দেশ করে ভাইয়া বললেন, গাছগুলো আমাদের আপ্লুত করে, আবেগ এনে দেয় আর দস্যুরা গাছের দিকে তাকায়ই এইভাবে যে ‘এটা আমার ড্রেসিংটেবিল, ওটা হল খাট কিংবা সোফা’ একটি গাছ থেকে ডাক দিতে দিতে রাস্তার এপার থেকে ওপার গিয়ে বসে একটি বিশাল কাউ ধনেশ পাখি (Indian Pied Hornbill)। আমরা শুধু দাড়িয়ে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। একটি পার হতে হতেই অপরটিও তার পিছু নিয়ে ধীর গতিতে ভারী পাখাগুলো বিশেষ প্যাটার্ণে ওঠানামা করে বনের ভেতর গায়েব হয়ে যায়। জুরাসিক পার্কের কোন দৃশ্যের চেয়েই এই দৃশ্য কম নয়! বিশ্ময় কাটিয়ে উঠে আমরা দুটো দীর্ঘস্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হাটি। সন্ধ্যার আগে সার্ভে শেষ করে শ্রীমঙ্গল পোঁছাতে হবে। বনদস্যু, বনবিভাগ, রাস্তা, রেলওয়ে, খারাপ কোম্যানেজমেন্ট, পরিকল্পনাবিহীন ট্যুরিসম, শেভরন, চা-বাগান এতো ক্ষতির পরও এখানে পাওয়া সাপ, পাখি অন্যান্য বণ্যপ্রাণী নির্দেশ করে বনমাতা নিজের সবটুকু দিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে! আমরা পারবো মা-কে সাহায্য না করে চুপ করে বসে থাকতে? যে যেখানে থাকি, নিজের অবস্থানে থেকেই আমরা বিশ্বাস করি, এ লড়াইয়ে আমরা সবাই লাউয়াছড়ার সাথ দেব।
All the Snake Photos are Taken By Shahriar Caesar Rahman
লেখকঃ রেজা নূর মইন, প্রকৃতিপ্রেমী,, সৌখিন ফটোগ্রাফার
ছবি কৃতিত্বঃ লেখক স্বয়ং
Excellent!
লেখাটি পড়ে অনেক ভাল লাগলো। এতো বড় লেখা তারপরও এক নিমিষেই শেষ করে ফেললাম… (y)