লুপ্ত ধানের রক্ষক

নিছক শখের বসে নয়, ভালোবেসে তিনি রক্ষা করে চলেছেন ধানগুলো। ৩০ বছর ধরে চলছে তাঁর এই ধান রক্ষার সংগ্রাম। ছোট ছোট প্লটে চাষ করে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রায় ৬০ প্রজাতির ধান। এসব ধান বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে প্রায় বিলুপ্ত। নতুন দিনের মানুষ ভুলে গেলে কী হবে; বরেন্দ্রভূমির এক নিভৃত গ্রামের গরিব কৃষক ইউসুফ মোল্লা বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্য।
এসব ধানের বেশির ভাগই খরা ও বালাইসহিষ্ণু। চাষ করতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করতে হয় না বললেই চলে। স্বাদ-গন্ধেও আছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। ভাপ ওঠা ভাতের ম-ম গন্ধ মোহিত করে মানুষকে। নিজের মতো করেই নিজ গ্রামে এসব ধানের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন ইউসুফ মোল্লা।
এরই মধ্যে ইউসুফ মোল্লার কাছে থাকা ‘রাঁধুনি পাগল’ ধানের ব্যাপারে অন্য এলাকার কৃষকদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে বীজ নিয়ে আবাদ শুরু করেছেন কৃষকেরা।
এই ধান সম্পর্কে ইউসুফ মোল্লা বলেন, রাঁধুনি পাগল চালের ভাতের মিষ্টি গন্ধ শুধু রাঁধুনিকেই পাগল করে না, আশপাশের মানুষকেও মোহিত করে। শুধু সুগন্ধই নয়, খেতেও সুস্বাদু। এটা দামি চাল হিসেবে বাজার পেতে পারে বলে মনে করেন ইউসুফ মোল্লা। তিনি আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে ছোট ছোট প্লটে চাষ করেন বীজ সংগ্রহে রাখার জন্য।lupto dhan
পেছনের কাহিনি: ইউসুফের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে। ধানের প্রতি প্রেম তাঁর শৈশব থেকেই, যা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। বেশি ভাইবোনের সংসারে লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণীর বেশি এগোয়নি। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে লেগে যেতে হয়েছে। কিশোর বয়স থেকেই বাবাকে দেখে এসেছেন বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সুগন্ধি মিহি ধানের আবাদ করতে। বরাবরই বাবা এসব সুগন্ধি ধানের ভাত খেতেন এবং অতিথি আপ্যায়ন করতেন। বাবা মারা গেছেন প্রায় ২৫ বছর আগে। কিন্তু তাঁর অভ্যাস ও ঐতিহ্য ছাড়তে পারেননি ইউসুফ। বিভিন্ন এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পুরোনো ধানের বীজ সংগ্রহ করে আবাদের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে চলেছেন। বাবার মতো তিনিও বিশেষ গুণের এই ধানের ভাত নিজে খান এবং অতিথি আপ্যায়ন করেন। এসব ধান এলাকা থেকে হারিয়ে যেতে দেখে সংরক্ষণ করার ইচ্ছা জাগে তাঁর।
তাঁর সংগ্রহে: রাঁধুনি পাগল, মধুমাধব, চিনিশংকর, দাদখানি, রঘুশাইল, ঝিঙাশাইল, সোনাশাইল, ইন্দ্রশাইল, লতাশাইল, মুগি মালসেরা, শনি আউশ, হিদা, নীলকণ্ঠ, কাইলারাই, জটা বাঁশফুল, দিঘা, কালশনি এলাই, টোপা বোরো, সোনাকাঠি, খৈলঝুড়ি, কালিভাজরা, গঙ্গশুলি, সাথিয়া, ভোজনা, কাকুরি, মুলাশাইল, উরিষ্যা, কালিখুজি, বাসমতি—এ রকম ৬০ প্রজাতির ধান ইউসুফের সংগ্রহে আছে। এর মধ্যে রাঁধুনি পাগল, মধুমাধব, চিনিশংকর, দাদখানি ধান চিকন ও সুগন্ধি, খেতেও সুস্বাদু। ভাদ্র মাসে ওঠা শনি আউশের পান্তা খেতে খুব মিষ্টি। প্রচলিত আছে, ঘি দিয়ে ওলের ভর্তা আর শনি আউশের ভাত খেলে মুখে ঘা হয় না। দিঘা ধান বেশি পানিতেও বাঁচতে পারে। চাল লাল। ভাত খেতে মিষ্টি ও আঠালো। হিদা ধানের চাল মোটা। এই ধান দিয়ে চিঁড়া হয় ভালো। ভালো মুড়ি হয় নীলকণ্ঠ ধানের। কেবল ধান নয়, বিশেষ যত্নে মাটির হাঁড়িতে রাখা ২৫-৩০ বছরের পুরোনো চালও রয়েছে তাঁর কাছে।
এক দিন দুবইল গ্রামে: তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভা থেকে আট কিলোমিটার দূরে দুবইল গ্রাম। মুণ্ডুমালা থেকে আঁকাবাঁকা পথ ঢুকেছে দুবইল গ্রামে। বরেন্দ্রর বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পথের দুই পাশে উঁচু-নিচু তাক তাক বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। দুবইল গ্রামের সিংহভাগ বাড়িই মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি। ইউসুফ মোল্লার বাড়িটিও মাটির। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি মোড়। সেই মোড়ে একটি বড় প্রাচীন তেঁতুলগাছ। তেঁতুলগাছের সুশীতল ছায়া ঘিরে দোকানপাট। জিজ্ঞাসা করতে গ্রামেরই একজন দেখিয়ে দেন ইউসুফ মোল্লার বাড়ি। আধা কিলোমিটার দূরের বাড়িতে গিয়ে ইউসুফ মোল্লাকে নিয়ে আবারও ফিরতে হলো মোড়ে। কারণ, মোড়ের কাছেই তিনি গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। পাকা সড়কের পাশে ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটি ঘরের একটির মেঝেতে রাখা আছে মাটির হাঁড়ি ও বস্তায় নানা ধরনের পুরোনো সব ধানের বীজ। এগুলো ৩০-৪০ বছর আগেই এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর সেখানে জায়গা করে নিয়েছে উচ্চফলনশীল নামধারী নানা ধরনের ধান। ইউসুফ মোল্লা ধানের বীজ দেখাতে দেখাতে গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছিলেন। তাঁর বাড়িতেও এমন বহু মাটির হাঁড়িতে ধানের বীজ ও চাল রয়েছে। সংগ্রহশালায় স্থানসংকুলান না হওয়ায় তিনি এসব বাড়িতে রেখেছেন।
যে যা বলেন: তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসানুল কবীর কামালী বলেন, একসময় এ দেশে ১০ হাজার প্রজাতির ধান ছিল। এখন আছে এক হাজার। তাই ইউসুফ মোল্লা যে বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত ধানের বীজ সংরক্ষণ করে চলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে রাঁধুনি পাগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির খরা সহনশীল ধান বরেন্দ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছেন পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) বারসিক গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ ইউসুফ মোল্লার পুরোনো ধান রক্ষা সম্পর্কে বলেন, ‘যে কাজ রাষ্ট্রের করার কথা, তা করছেন গ্রামের একজন গরিব কৃষক। যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, তাতে ইউসুফ মোল্লার এসব ধানের কাছেই একদিন আমাদের ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যেসব ধান তিনি ভালোবেসে রক্ষা করে চলেছেন, সেগুলো জাতীয় সম্পদ।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (অব.) রবীন্দ্র কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমি ইউসুফকে অনেক দিন ধরে চিনি। তাঁর কাজ দেখতে ওই গ্রামেও গেছি একাধিকবার। তাঁর কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

সুত্রঃ প্রথম আলো, ১৬,০৩,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics