
ব্রাজিলের সর্প নগরী!
হুমায়রা হেদায়েত স্বর্ণা
ধরুন, ফেনিল উত্তাল সাগরের মাঝে সবুজ একটি দ্বীপ।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন দ্বীপটিকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করেছে, ঠিক যেন রূপকথার মতো। নগরের ব্যস্ততা থেকে বাঁচতে আপনি না হয় চলেই গেলেন সেখানে। কিন্তু বিধি-বাম!!! ব্যস্ততা কাটাবেন কোথায়?? উল্টো ভয়ঙ্কর বিষধর সাপের হাত থেকে বাঁচতে পড়িমড়ি করে আপনাকে ফিরে আসতে হবে।
ভাবছেন এটা কোনো গল্প বা মুভির কাহিনী?? না পাঠক। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মাতোয়ারা সেই ব্রাজিলের সাও পাওলোর উপকূলে রয়েছে সত্যিকার অর্থেই এমনই এক দ্বীপ। ওই দ্বীপে এমন এমন সব ভয়ঙ্কর সাপের বাস যে ব্রাজিল সরকার বাধ্য হয়ে দ্বীপটিতে সাধারণ মানুষের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ, দ্বীপটিতে আপনি যাবেন তো ঠিকই তবে জীবন নিয়ে ফেরার নিশ্চয়তা নেই।
এই দ্বীপটি এক মাইল কিংবা দুই মাইল নয়, দীর্ঘ ২০ মাইল। পুরোটা জুড়ে কেবল সাপ আর সাপ। একটি দুটি নয়, চার হাজার সাপের বিশাল এক দল এই দ্বীপে নিজেদের রাজ্য গড়ে তুলেছে। স্থানীয়দের মতে, এখানে প্রতি বর্গমিটারে পাঁচটা সাপ থাকে। দ্বীপটি দেখতে অনেকটা সাপের মতোই। অসংখ্য বিষধর সাপের স্বর্গরাজ্য হওয়ায় এই দ্বীপটিকে সবাই‘The Snake Island’ নামে চিনে। ব্রাজিলীয় ভাষায় এর নাম ‘ ইহা ডি কুইমাডা গ্র্যান্ডি’।
শুধু হাজার সাপের নয়, সর্পরাজ্যের বিষধর সাপের রাজা গোল্ডেন ল্যান্সহেডেরও বাস এই দ্বীপটিতেই। গোল্ডেন ল্যান্সহেডকে এ দ্বীপটি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। এর বৈজ্ঞানিক নাম Bothrops insularis। এটি দেখতে উজ্জ্বল হলুদাভ ও বাদামী বর্ণের। এরা গড়ে ২৮ ইঞ্চি এবং সর্বোচ্চ ৪৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। মাথা তীক্ষ্ম আকৃতির বিধায় একে লানচিহেড ভাইপার নামে ডাকা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যুর কারণ এই সাপ।
গোল্ডেন ল্যান্সহেডের বিষ অন্য বিষধর সাপগুলোর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি শক্তিশালী ।এরা আকাশে উড়ন্ত পাখিকে ছো মেরে মুহূর্তে বিষের সাহায্যে নিস্তেজ করে উদরপূর্তি করে।এর বিষ এতটাই শক্তিশালী যে এই বিষ মানুষের শরীরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তা শরীরের মাংস পর্যন্ত গলিয়ে দিতে পারে। তবে ঠিক কীভাবে এই সাপগুলো এতটা বিষধর হয়ে উঠেছে তা একরকমের রহস্যই রয়ে গেছে।
ভয়ঙ্কর এ দ্বীপটিকে ঘিরে ব্রাজিলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মুখরোচক নানা কল্পকাহিনী।এর একটি হলো এক জেলের গল্প। একবার এক জেলে না বুঝে ঢুকে পড়েছিল ওই সাপের দ্বীপে। দূর থেকে থোকায় থোকায় কলা দেখেছিল জেলেটি। কিন্তু কলা আনতে গিয়ে সাপের ছোবল খেয়ে কোনো রকমে নিজের নৌকায় এসে উঠতে পেরেছিল। কয়েকদিন পর সেই জেলেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল তার শরীর থেকে।একসময় ওই দ্বীপে বাতিঘর ছিল। ওই বাতিঘর রক্ষণাবেক্ষণকারী বাতিঘরেরই উঁচু মাচানে পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করতেন। এক রাতে কয়েকটি সাপ আক্রমণ করে তাদের ঘরে। জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। ঘরে তখন ছিল বাতিঘর দেখাশোনাকারী লোকটি, তার বউ আর তিন ছেলেমেয়ে। সাপের আক্রমণে কোনো রকমে তারা নৌকায় এসে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু রেহাই মেলেনি। সাপেরা তাদের তাড়া করেছিল। গাছের উঁচু ডালে উঠে বিষ ছুঁড়ে মেরেছিল তাদের দিকে। তারপর ব্রাজিলের ঊপকূলে পৌঁছার আগেই মৃত্যু হয় সবার। এমন বিষাক্ত দ্বীপে এরপর থেকে আর কোনো মানুষ থাকে না। কাজেই ওখানে কোনো মনুষ্য বসতি নেই।
নিষিদ্ধ এই সর্প নগরীতে জনমানবের বাস না থাকলেও প্রতিবছর সাপের ওপর গবেষণা করতে কিছু বিজ্ঞানীকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়া ব্রাজিলীয় নৌবাহিনীর সদস্যদেরও দ্বীপটিতে যেতে হয় প্রায়ই। এদিকে, লিচেনহেডের বিষ মহামূল্যবান হওয়ায় এ দ্বীপটিতে চোরাকারবারীরা প্রায় ঢুঁ মারেন বলেও ধারণা করা হয়। কালো বাজারে এর দাম প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার পাউন্ড। চোরাকারবারীদের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের ফলে এই বিষধর সাপ এখন বিলুপ্তির পথে।তবুও, রাজত্বসহ দ্বীপের পুরো মালিকানা কিন্তু এখনো সর্পদের দখলেই।
হুমায়রা হেদায়াত স্বর্ণা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
well done !!