
স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র আলোক মশাল কি চিরতরেই নিভে যাবে??
ফারজানা হালিম নির্জন
এক হাতে মশাল আর অন্য হাতে স্বাধীনতার ফলকে খোঁদাই করে লেখা একটি তারিখ ৪ জুলাই,১৭৭৬। আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের মূর্ত্য প্রতীক হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন সদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে জেগে ওঠা এক নারী। সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলা এই অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব ধারণকারী মূর্তিটি ফরাসীরা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রকে। হার্ডসন নদীর মুখে লিবার্টি আইল্যান্ডে সেই ১৯২৪ সাল থেকে তিনি নির্ভীক চিত্তে মশালের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রে,এমনকি গোটা বিশ্বেই। আর সেই সাথে মনে করিয়ে দিচ্ছেন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের তালিকার শুরুর দিকেই উজ্জ্বল অক্ষরে ছাপা হয়ে আছে তাৎপর্যপূর্ণ এই তিনটি শব্দ – “স্ট্যাচু অফ লিবার্টি”। এই মূর্তিটির নকশা তৈরীর সময় ফ্রেডরিক বার্থোল্ডি এবং গুস্তাব আইফেল মনের ভুলে একবারও কি ভেবেছিলেন,তাঁদের এই অসামান্য সৃষ্টি টি একদিন পানির নিচে হারিয়ে যেতে পারে!
সিডনী অপেরা হাউজ,যার ছবি দেখলে একটি শিশুও নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে,এটা অস্ট্রেলিয়ার ছবি! সেই অস্ট্রেলিয়ার অপেরা হাউজ,যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যচু অফ লিবার্টি,যুক্তরাজ্যের টাওয়ার অফ লন্ডন, বিশ্বের এইসব ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলো হয়তো একদিন ইতিহাসের বইয়েই শুধু টিকে থাকবে,থাকবেনা তাদের কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব। এ ধরণের ভয়ংকর আশংকাই ছুড়ে দিলেন এবার কয়েকজন গবেষক। জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু বিজ্ঞান অধিদপ্তর মনে করছেন,চলতি শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থাৎ ২১০০ সালের শুরুর দিকে,পৃথিবীর মোট ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের এক-পঞ্চমাংশ সম্পূর্ণরুপে বিলীন হয়ে যাবে, শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে! সবচাইতে বড় হুমকী হলো বরফ গলন আর ফলস্বরূপ সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি। সেই তালিকায় বাদ পড়বেনা অপেরা হাউজ কিংবা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মত নিদর্শনও।
অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বেন মারজেইয়ন বলেন, “যখনই আমরা জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করি কিংবা চিন্তিত হই,তখন কেবল অর্থনৈতিক ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতি-সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দেই। কিন্তু আমরা বিশ্বের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্য বহনকারী সেই স্থাপনাগুলো অথবা নিদর্শনগুলোর কথা ভুলে যাই। এগুলো নিয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত,কারণ এসব তো পরিবেশেরই অংশ!”
তিনি আশংকা করছেন,ইতালীর পিসা নগরীর সেই বিখ্যাত “হেলানো মিনার” হয়তোবা ২১০০ শতাব্দীর অনেক আগেই সত্যি সত্যিই হেলে পড়বে চিরদিনের মত। যদিও এটি সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থাপনা নয়। তবুও,তাপমাত্রার অল্প বৃদ্ধির কারণেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতখানি বেড়ে যাবে,ততটুকুই যথেষ্ট এই হেলানো মিনারকে পুরোপুরিভাবে হেলিয়ে দিতে। এছাড়াও,ইতালীর ন্যাপলস,বেলজিয়ামের ব্রুজস,রাশিয়ার পিটারসবার্গ কোনোকিছুই রেহাই পাবেনা এই ভয়াবহ হুমকীর হাত থেকে। রেহাই পাবেনা দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার মানুষও। তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা মন্থর গতিতে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। “ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ” এর মতে,২১০০ সালে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ২৬-৮২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে! সেই পানির স্রোতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়া গ্রহটিতে ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলো কি এভাবেই হারাতে বসেছি আমরা! ২০১৪ তে অবস্থান করছি এখন; টেনেটুনে হাতে আছে আর মাত্র একটি শতাব্দী। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ,প্রভাব,দমন এই সবকিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এটা ঠিক,কিন্তু সেখানে বিশ্বের ঐতিহ্য রক্ষার পেছনে কতটুকু সতর্ক বিশ্বের অগ্রপথিকরা! এখন থেকেই যদি এই দিকটির প্রতি কঠোর ও পরিপূর্ণ নজর দেওয়া না হয়,তবে ২১০০ সাল কোন দুঃসংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করছে এই পৃথিবীবাসীর জন্য?