অজগর গবেষণা : শরীরে যন্ত্র, ছুটছে ‘আশা’
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
অজগর, নাম শুনলেই শিউরে ওঠে শরীর! তবে অনেকেরই অজানা অজগরের বিষ নেই। শিকারকে এরা পেঁচিয়ে হত্যা করে গিলে ফেলে। ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে এরা আমাদের ফসলদির ব্যাপক উপকার করে থাকে। বন, জলাভূমি ও গ্রামগঞ্জের ঝোপঝাড়ই এদের আবাসস্থল। মাঝে মাঝে এরা খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আতংকিত মানুষের হাতেই তারা নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। তবে এই বিপন্ন অজগরকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মত ক্ষুদ্র অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে অজগরের শরীরে স্থাপন করা হলো রেডিও ট্রান্সমিটার। এটিই আমাদের দেশে সাপের উপর রেডিও ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে প্রথম গবেষণা। বৃহস্পতিবার বিকেলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গভীর বনে ওই অজগরটিকে অবমুক্ত করা হয়। আমেরিকার বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী স্কট ট্রেগেসার, স্বনামধন্য সরীসৃপ গবেষক শাহরীয়ার সিজার রহমান, গবেষক ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, ভারতের সরীসৃপ গবেষক চিরাগ রায়, প্রকল্পের জনসংযোগ সমন্বয়কারী রূপা দত্ত, জা.বি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর ইসলাম আশিক প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকেই অজগরটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করার কাজ শুরু হয়। বন অধিদপ্তর ও বন্যপ্রাণী গবেষণা সংগঠন ক্যারিনামের যৌথ উদ্যোগে অজগর গবেষণা প্রকল্পের আওতায় রেডিও ট্রান্সমিটারযুক্ত ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে স্ত্রী প্রজাতির এ অজগরটির নামকরণ করা হয় ‘আশা’ এ অজগরটি বয়স তিন বছর এবং ওজন ৮ কেজি ওজন। আশার অবমুক্তির মাধ্যমে এ প্রকল্পের শুভসূচনা হয়।
ক্যারিনামের প্রধান নির্বাহী এবং এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক ড. এসএমএ রশিদ কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অজগরের বায়োলজিক্যাল তথ্যগুলো সংগ্রহ করার জন্য ওর শরীরে ‘রেডিও ট্রান্সমিটার’ স্থাপন করা হয়েছে। ওর গতিবিধি কেমন, ওরা কোথায় কোথায় বিচরণ করে, কতক্ষণ বিচরণ করে প্রভৃতি তথ্যগুলো আমরা পেয়ে যাবো। এছাড়াও ‘আই-বাটম’ নামের আরেকটি যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা ওর গায়ের তাপমাত্রাও মাপতে সক্ষম হবো। এ সমস্ত তথ্যগুলোই তথ্যগুলোও সংরক্ষণ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিষয় তো এখানে রয়েছে। পরিবেশের সাথে ‘আশা’ নিজেকে কিভাবে খাপখাইয়ে নিচ্ছে সে বিষয়টিও আমরা জানতে পারবো।’
তিনি আরো বলেন, ‘অজগর সম্পর্কে তো আমাদের আগ্রহ অনেক। কিন্তু এর মৌলিক তথ্যগুলোই আমাদের কাছে নেই। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যাবো। ওই তথ্যগুলো সংগ্রহের পর বন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিলুপ্তপ্রায় এ অজগর প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আমাদের করণীয় পরিকল্পনাগুলো তৈরি করবো।’ তিনি ট্রান্সমিটার সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা সাপটির গায়ে যে ট্রান্সমিটার স্থাপন করেছি ওই ট্রান্সমিটারের ব্যাটারি ক্ষমতা থাকবে দু’বছর পর্যন্ত। সময়সীমা শেষ হওয়ার পূর্বেই সাপটিকে আমরা খুঁজে বের করে অল্পসময়ের ছোট একটি অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে ওই ট্রান্সমিটারটি বের করে ফেলে পুনরায় তাকে বনে ছেড়ে দেয়া হবে। এইভাবে আমাদের পরিকল্পনা ছিল দশটা অজগরকে নিয়ে গবেষণা করার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আমাদেরকে চারটার অজগরের শরীরের ট্রান্সমিটার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে।’
অজগর গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক শাহরীয়ার সিজার রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বার্মিজ পাইথন বা অজগরকে রেডলিস্টভুক্ত করছে। অজগর নিধন, আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া, প্রতিকূল পরিবেশসহ নানা কারণে বাংলাদেশেও এর সংখ্যা দ্রুতই কমে যাচ্ছে। এ বিপন্ন প্রাণীটিকে সংরক্ষণ করতে এর শরীরে রেডিও ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়েছে। এই সাপের প্রধান অসুবিধা হলো এদের সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। সাথে সাথে লুকিয়ে যায়। রেডিও ট্রান্সমিটার সংযোজন ছাড়া অজগরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। ট্রান্সমিটারটি বসিয়ে অজগরটিকে ছাড়ার পর তাকে বারবার অনুসরণ করতে হয়। আমাদের হাতে থাকা রেডিওতে ‘বিপ’ ‘বিপ’ ‘বিপ’ এ সংকেতধ্বণি জানান দিবে ওর উপস্থিতি। কিছুদিন আমরা একটানা ২৪ ঘন্টাই ওকে অনুসরণ করবো। ওর কিছু তথ্য সংগ্রহ আমাদের কাছে চলে আসার পর এরপর আমরা দিনে একবার করে ওকে রেডিও-ট্রেকিং করবো।’
শাহরীয়ার সিজার রহমান আরো বলেন, ‘আধঘন্টার একটি ছোট্ট অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে অজগরের চামড়া নিচে ট্রান্সমিটারটি বসিয়ে দেয়া হয়। শেলাইয়ের পর অগজরের পেটে একটি আবরণ দেয়া হয়। এটি শুকানো জন্য আমরা প্রায় ৪৮ ঘন্টা অপেক্ষা করে থাকি। অগজরের মোট ওজনের তুলনায় ট্রান্সমিটারের ওজন শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ট্রান্সমিটারের ওজন ২০ গ্রাম। দৈর্ঘ্য প্রায় ১ দশমিক ৩ অনেকটা পেন্সিল ব্যাটারির মত। ৫শ’ মিটার থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত এই ট্রান্সমিটারের কার্যক্ষমতা। ১৯৭০ সাল থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার সাপের উপর গবেষণা হচ্ছে। সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় মাংসাশি প্রাণী অজগর। অবশ্য এক সময় বাঘ ছিল। তাই অজগর প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে এ গবেষণার পাশাপাশি বনের পার্শ্ববর্তী একালায় গণসচেতনতামূলক কাজও আমরা করছি।’
লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
সূত্র : ২০ জুলাই ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ