অনিন্দ্যসুন্দর মেঘকুমারী

সেপ্টেম্বর ২০১২-এ ওকে প্রথম দেখি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার আদমপুর বিটের গহিন জঙ্গলে। মাটি থেকে প্রায় আড়াই মিটার উঁচুতে গাছে ঝুলে থাকা একগোছা সাদা ফুলের ওপর বসে ছিল সে। দেখতে বেশ লাগছিল। তার বসার ভঙ্গি, দেহের গঠন, আকার ও রঙে অভিভূত হয়েছিলাম। মনটা ভরে গিয়েছিল সৌন্দর্যে।
ছবি তোলা শেষে যখন চলে যাচ্ছিলাম, তখনো পেছন ফিরে দেখছিলাম তাকে। সে কিন্তু তখনো বসে ছিল। এরপর এ বছরের ১২ জানুয়ারি লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের গহিনে যখন তার মতোই বিধাতার আরও কিছু অপরূপ সৃষ্টির ছবি তুলছিলাম, তখন হঠাৎই সে আমার ফ্রেমে ধরা পড়ল। তবে ২০ সেকেন্ডের জন্য। মাত্র দুটো ক্লিক করার সুযোগ দিয়েছিল। 2013-03-28-19-41-12-51549cd887bb3-untitled-7
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে আর কেউ নয়, এ দেশের সুন্দরতম এক রাজকীয় প্রজাপতি ‘সিলভিয়া’ অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী ও মনোয়ার হোসেনের ফিল্ড গাইড অনুযায়ী এর বাংলা নাম ‘মেঘকুমারী’ নামটা বেশ মানিয়েছে ওর দেহের রঙের সঙ্গে। ইংরেজিতে ওকে বলে ‘ক্লিপার’ (The Clipper)। Nymphalidae পরিবারভুক্ত এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Parthenos sylvia. এ দেশে যতগুলো সুন্দর প্রজাপতি রয়েছে ‘মেঘকুমারী’ বা ‘সিলভিয়া’ তাদের মধ্যে অন্যতম। সৌন্দর্যের বিচারে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রজাপতিগুলোর মধ্যে মেঘকুমারীর স্থান ষষ্ঠ। এটি আকারে বেশ বড় হয়। যেন এক রাজকীয় প্রজাপতি!
মেঘকুমারী বনবাসী প্রজাপতি। শহর-বন্দর-গ্রামে এদের দেখা মেলে না। মূলত আর্দ্র চিরসবুজ, আধা-চিরসবুজ ও নদী-নালা-ছড়া আছে এমন স্যাঁতসেঁতে পাতাঝরা বনে দেখা যায়। সিলেট ও চট্টগ্রামের গহিন বনে বেশ আছে। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশ সক্রিয় থাকে। ফুলের নির্যাস পান করার সময় ডানা প্রসারিত করে রাখে। প্রসারিত অবস্থায় ডানার মাপ ১০৫-১২৫ মিমি। অত্যন্ত দ্রুত, সুন্দর ও রাজকীয়ভাবে উড়তে পারে। সাধারণত গাছের বেশ উঁচুতে অবস্থান করে। অনেক সময় ভেজা মাটিতে নেমে আসে। ডানা মেলে রোদ পোহায়।
মেঘকুমারীর ডানার ওপরের দিক উজ্জ্বল সবুজ। সামনের ডানা লম্বাটে ও ত্রিকোণাকৃতির। ডানার গোড়ার দিকে দুটি বড় কালো আঁকাবাঁকা ডোরা। সামনের ডানায় কয়েক সারি প্রায় স্বচ্ছ বরফসাদা দাগ। আর পেছনের ডানায় থাকে কালো শিরা এবং গোড়ার দিকে কালো আঁকাবাঁকা ডোরা। ডানার নিচের দিকের রং হালকা নীল ও সেখানে কালো ডোরা অনুপস্থিত।
স্ত্রী মেঘকুমারী পাতার ওপর দিকে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা পাতাপ্রতি একটি। ডিমের আকার গম্বুজের মতো ও রং সাদাটে। ডিমের গায়ে কাঁটা বা চুলের মতো থাকে।
বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার অনেক দেশেই এদের দেখা যায়। প্রজাপতি সংগ্রহকারীদের কাছে মেঘকুমারী খুবই পছন্দনীয়। আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য মেঘকুমারীকে নিয়ে যেন কেউ এমন ব্যবসায় মেতে উঠতে না পারে, সেদিকে সচেতন থাকতে হবে। রক্ষা করতে হবে অনিন্দ্যসুন্দর এই প্রজাপতিটিকে।

আ ন ম আমিনুর রহমান

সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৯,০৩,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics