বাড়ছে বৈশ্বিক উদ্বেগ; প্রবাল প্রাচীর কি হারিয়ে যাচ্ছে ??

তানভীর হোসেন

পৃথিবীর স্থলভাগে মনুষ্য প্রজাতি এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের বাস যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সকল উপাদানই যোগান দেয়। আমাদের দৃষ্টির অগোচরে এর চেয়ে বহুগুন প্রাণী এবং উদ্ভিদ রহস্যময় সমুদ্রে বাস করে যারা পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানে বড় একটা ভূমিকা রেখে চলেছে। সমুদ্রের তলদেশে এই বিশাল প্রানীজগতের আবাসস্থল হচ্ছে প্রবাল প্রাচীর যা আমরা coral reef নামে জানি। প্রায় ২৫% এরও অধিক সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল এই প্রাচীর সমুদ্রের তলদেশের প্রায় ২% আয়তন দখল করেছে। ক্রান্তীয় রেইনফরেস্টের সামুদ্রিক সমতুল এই অঞ্চল আজ নানা কারনে হুমকীর সম্মুখীন।

 প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংসের বহুবিধ বৈশ্বিক কারন রয়েছে যার পেছনে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ই দায়ী। তবে মানুষ তার নিজের কাজের মাধ্যমেই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে মানুষের অবদানটাই অনস্বীকার্য। পরিবেশের অসুস্থতাই এর পিছনে মূল কারণ যার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে মানুষজাতি। প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসের কিছু হেতু বিশ্লেষণ যায় এভাবে,

সভ্যতার সুচনালগ্ন থেকে মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলে যুক্ত হচ্ছে যা বায়ুমন্ডলে ইহার ঘনমাত্রা ২৮০ থেকে ৩৮৫ ppm এ উন্নীত করেছে। এই বৃদ্ধিরত কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ও মহাসমুদ্রসমুহের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব বাড়াচ্ছে যা খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে পৃথিবীর প্রানীকূলের উপর। মহাসমুদ্রসমুহ বায়ুমন্ডলের প্রায় ৫২৫ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে যা আমাদের বায়ুমন্ডলকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এই শোষণ আবার সমুদ্রের আভ্যন্তরীন রসায়ন ও প্রাণীকুলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।coral 8 বিভিন্ন পানিসম্পদ বিষয়ক জরিপে দেখা গেছে যে, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের ফলে সমুদ্রের পানির pH উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। শিল্প বিপ্লবের সুচনা থেকে এ পর্যন্ত সমুদ্র পৃষ্ঠের গড় pH এর মান ৮.২১ থেকে ০.১ একক কমে ৮.১০ তে নেমে এসেছে।  Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর মতে, অব্যাহত কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরনের ফলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বায়ুমন্ডলে এর ঘনমাত্রা ৫০০ ppm ছাড়িয়ে যাবে এবং শতাব্দীর শেষের দিকে তা ৮০০ ppm অতিক্রম করবে। এর ফলে ২১০০ সালনাগাদ সমুদ্রের পানির pH ০.৩ একক পরিমান হ্রাস পাবে। কার্বন ডাই অক্সাইড সমুদ্রের পানির সাথে বিক্রিয়ায় pH হ্রাস করায় কার্বনেট আয়নের সহজলভ্যতা কমিয়ে দেয় যা বিভিন্ন সামুদ্রিক জীব যেমন কোরাল, সামুদ্রিক প্লাংকটন, শেলফিস ইত্যাদির ত্বক গঠনে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। উক্ত ঘটনা যা সাধারনভাবে ocean acidification নামে পরিচিত, অনাগত দশকসমুহে সমুদ্রের মৌলীক জীব বৈজ্ঞানিক এবং ভূ-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিরাট প্রভাব ফেলবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বনেট আয়নের পরিমান কমে যাওয়ার ফলে হ্রাসকৃত প্রবাল প্রাচীর পর্যটন শিল্প ও মৎস শিল্পে অসামান্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।প্রবাল প্রাচীর

 বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য তাপশোষনকারী গ্যাসের পুঞ্জীভবনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটে। এই গ্যাসগুলো পৃথিবীর ব্লাঙ্কেট হিসেবে কাজ করে যা সূর্যের তাপকে বায়ুমন্ডল ভেদ করে যেতে বাধা দান করে। প্রাথমিকভাবে জ্বীবাশ্ম জ্বালানী দহন ও বনভুমি নিধন হচ্ছে এর প্রধান কারণ এবং অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, এটি সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। সামুদ্রিক উষ্ণায়ন তাপমাত্রা পরিবর্তনে সংবেদনশীল প্রবাল জীবসমুহের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৃহৎ পরিসরে প্রবাল প্রক্ষালন ঘটতে পারে। এর ফলে প্রবাল পলিপসমুহ তাপ অথবা অতিবেগুনি রশ্মির চাপে এদের অভ্যন্তরে বসবাসকারী শৈবালসমুহকে তাড়িয়ে দেয়। zooxanthellae নামক শৈবাল প্রবালসমুহের প্রয়োজনীয় শক্তির ৮০% সরবরাহ করে এদের অস্তিত্বের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদানে পরিনত হয়েছে। শৈবাল প্রবালের রংয়ের জন্যও দায়ী, তাই যখন শৈবাল দূরীভুত হয় তখন এদের রঙও সাদা হয়ে যায়। সাদা প্রবাল আবার রঙ্গিন হতে পারে যদি পরিস্থিতি দ্রুত অনুকূলে চলে আসে। যাই হোক, অব্যাহত মানবসৃষ্ট চাপের ফলে প্রবাল প্রাচীর সত্যিই হুমকীর মুখে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রক্ষলিত প্রবাল কলোনী ধ্বংসও হয়ে গেছে।coral 2

 বিগত কয়েক দশকে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গ্যাস পানিতে দ্রবীভূত হয়ে প্রবালের কাঠামোকেও দ্রবীভূত করে ফেলে। ফলে অধিক কার্বন ডাই অক্সাইড সম্বলিত পানিতে উৎপন্ন কোরাল সমুহ দূর্বল কাঠামো বিশিষ্ট হয় যেগুলো স্রোত, অবিবেচক পর্যটক এবং অসাবধান জেলেদের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞানীরা প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসের পেছনে পানি দূষণকেই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই হুমকি বিভিন্ন উৎস থেকে আসে। উদাহরণ স্বরুপ তেল, গ্যাস, কীটনাশক ইত্যাদির দূষণ প্রবাল এবং সামুদ্রিক জীবনকে বিষাক্ত করে ফেলে। মানুষ ও জীবজন্তুর বর্জ্য অথবা সার সমুদ্রের পানিতে নিক্ষিপ্ত হলে বা নদীর মাধ্যমে দূষিত পদার্থসমূহ সাগরে পড়লে তা প্রবালের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই দুষকগুলো প্রবালের চারপাশের নাইট্রোজেনের ঘনমাত্রা বাড়িয়ে দেয় যার ফলে শৈবালের অতিশয় বৃদ্ধি ঘটে এবং এগুলো প্রাচীরের উপর ছায়া তৈরি করে সূর্যের আলো প্রবেশে বাঁধা দেয়। সমুদ্র পৃষ্ঠে ভাসা আবর্জনাও প্রবালের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে কারণ এগুলোও পানির মধ্য দিয়ে সুর্যের আলো প্রবেশে বাধা দেয়। জেলেদের হারিয়ে যাওয়া বা পরিত্যাক্ত মাছ ধরার জাল(Ghost net) প্রবালের উপর জমা হয়ে উক্ত অঞ্চলের জীবকুলের উপর অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে।coral 7

 উপকুলীয় নির্মান কাজ, খনি-খনন বাঁধ নির্মাণ এবং উপকূলীয় নদীর নিকট খামার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কার্যাবলি সংশ্লিষ্ট এলাকার মাটিক্ষয় করে। যার ফলশ্রুতিতে মাটির কণাসমুহ সমুদ্রে পতিত হয় এবং প্রবাল প্রাচীরকে ঢেকে ফেলে। ইহা প্রবালের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আলো থেকে এদের বঞ্চিত করে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ও সী গ্রাস সমূহ যেগুলো সমুদ্রের পলির ফিল্টার হিসেবে কাজ করে সেসবও দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। ফলে ইহাও প্রবাল প্রাচীরে উপর পতিত পলির পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।

উপকূলীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে উপকূলীয় সম্পদের উপরও চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটিও প্রবাল প্রাচীরের সমস্যাকে তীব্রতর করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেভেলপাররা সরাসরি প্রবাল প্রাচীরের উপর সেতুর স্তম্ভ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মান করছে যা প্রবাল প্রাচীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এক সময় হংকং, সিঙ্গাপুর, ম্যানিলা এবং হুনুলুলু নামক বড় শহরগুলো প্রবাল প্রাচীরে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু মানুষের অব্যাহত চাপের ফলে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে অন্যান্য উপকূলীয় গোষ্ঠীতে উদীয়মান প্রাচীর সমুহও একই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে।

বর্তমানে মাছ ধরার কিছু পদ্ধতি খুবই ধ্বংসাত্নক এবং অনুপযক্ত। সায়ানাইড ফিশিং পদ্ধতি যেখানে মাছ ধরার জন্য সায়ানাইড ব্যবহৃত হচ্ছে যা সমুদ্রের প্রবাল এবং প্রানিসম্পদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।অনেক সময় সড়ক তৈরির সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রবাল উত্তোলন করা হয়, আবার প্রবাল থেকে নেয়া বালি এবং চুনাপাথর ভবন তৈরির সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। স্যুভেনির হিসেবে, অলঙ্কার হিসেবে পর্যটক এবং উন্নয়নশীল দেশের বাজারের জন্য রপ্তানীকারকদের কাছেও প্রবাল বিক্রয় করা হয়।coral 3

টুরিস্ট রিসোর্টের বর্জ্যসমূহ আশপাশের প্রবাল প্রাচীর পরিবেষ্টিত অঞ্চলে নিক্ষেপ করায় তা প্রবাল প্রাচীরের ক্ষতিসাধন করে। দূর্বল সেপ্টিক ট্যাংকে রক্ষিত আবর্জনা ছিদ্র দিয়ে পাশ্ববর্তী পানিতে ছড়িয়ে পড়ে যা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রবালের উপর জমা হয়। অসতর্ক বোটিং, ডাইভিং, মাছ ধরা ইত্যাদিও প্রবালের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অনেক সময় প্রবালের উপর জাহাজের নোঙ্গর ফেলা হয় যা উক্ত প্রবালের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

 হুমকীর সম্মুখীন এই প্রবাল প্রাচীর সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের উপর মারাত্নক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যা এর প্রানিবৈচিত্রকেও হুমকীর মুখে ফেলছে। প্রবাল প্রাচীরকে রক্ষা করার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বৈশ্বিক বানিজ্য পরিচালনার পরিবেশবান্ধব উপায় অবলম্বন এবং সিদ্বান্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। তাই সমগ্র বিশ্বের নেতৃবৃন্দকেও পরিবেশের সুস্থতা রক্ষে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে হয়তো খুব শীঘ্রই আমরা সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে বিরাট বিপর্যয় পরিলক্ষন করব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics