'অ্যাকুয়াপনিক্স'- মিসর মরুতে সবুজ বসন্ত

সাইফুর রহমান সুমন

আরব বসন্ত, হোসনে মোবারকের পতন, মুরসির উথান, সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্ষমতা দখল, এমন সব বহুমাত্রিক বিপ্লবে মিসর গত দু-তিন বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মিসরের অস্থির রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে আরেক নীরব বিপ্লব মিসরকে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। উষর মুরুতে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষিতে নয়া বিপ্লবের সূচনা করেছেন মিসরের কৃষকেরা।

মিসরের রাজধানী কায়রো শহর থেকে অদুরে গড়ে উঠেছে এক অসাধারণ কৃষি ফার্ম। যেখানে পানিতে চাষাবাদের মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কৃষি ফার্ম এবং কৃষকেরা। ফসল ফলিয়ে হলুদ বিরান ভূমিকে সবুজে রুপ দিয়েছে এই নতুন পদ্ধতির চাষাবাদ। যে জমিতে শুধু পাথর বালি আর বর্জ্য ছিল, তার জায়গায় এখন স্থান পেয়েছে পাকা টমেটো, বাধাকপি,এবং কৃত্রিম জলাশয় ভর্তি মাছ। এই আশ্চর্যজনক ফলন সেখানকার টেকসই পরিবেশের ইঙ্গিত প্রদান করছে।2013923131055680734_20

এবার আসুন পরিচিত হওয়া যাক একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে যিনি এই নতুন পদ্ধতির উদ্যোক্তা। ফারিস ফারাগ। ‘অ্যাকুয়াপনিক্স’ পদ্ধতি অবলম্বন করে যে বালুময় ধূধূ মরুভুমিতেও চাষাবাদ করা যায় তিনি তা জানতে পেরে এব্যাপারে উৎসাহিত হোন। তার কথায় “যেখানে তেল, জ্বালানী ও পানির দাম বেড়ে চলেছে, সেখানে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ সবাইকে নতুন করে ভাবতে সেখাবে”।

অ্যাকুয়াপনিক্স এক ধরনের খাদ্য শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। যেখানে পানিতে জলজ উদ্ভিদ ও মাছ চাষ একই সাথে হয়ে থাকে। পানির উৎস হতে পারে কোনো কৃত্রিম জলাধার, বড় চৌবাচ্চা, বড় পাইপ ইত্যাদি। এটি একটি আবদ্ধ স্বাদু পানির কৃষি ব্যবস্থা।

ফারিস ফারাগ এই পদ্ধতি সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়েছিলেন ভার্জিনিয়া আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ জেমস রেকয়ের কাছ থেকে। এই কৃষি বেবস্থা ১৯৮০ সাল থেকে স্বল্প পরিসরে চালু থাকলেও বর্তমানে তা মিসরের কৃষির মূলধারায় প্রবেশ করেছে এবং উন্নত বিশ্বও এটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। বাণিজ্যিকভাবে এই কৃষি ব্যবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। এতে একই জায়গায় অনেক ফসল ফলানো যায় এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা এতে পানির অপচয় কম হয়।

ইজিপ্টের বুসতানে যেখানে বাণিজ্যিকভাবে অ্যাকুয়াপনিক্সের ফার্ম রয়েছে সেখানে জলেধারগুলাতে তেলাপিয়া মাছ সাথে বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন শশা, পুদিনা, লেটুস, মরিছ, টম্যাটো ইত্যাদি চাষ করা হয়। ফারিস মনে করেন এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, “যদি একই অ্যাকুয়াপনিক্সে লেটুস ও মাছ চাষ করা হয় তাহলে প্রতি বছর ৬-৮ টন মাছ এবং ৪৫,০০০ লেটুস পাতা উৎপাদন করা সম্ভব” এখানে আরও একটি জিনিষের ব্যাবহার ফারিস করেন, তা হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশক পরিবর্তে জৈব কীটনাশক । এটি পরিবেশের জন্য ভালো এবং নিরাপদ।

মিসরে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৯ শতাংশ চাষযোগ্য জমির উপর নির্ভরশীল। তারা স্বাদু পানির উৎস হিসেবে যা ব্যবহার করে তা শিল্প, কৃষি ও ময়লা-আবর্জনা জনিত দূষণে ক্ষতির সম্মুক্ষীন হয়। মিসরের পানি দূষণকে ‘ব্ল্যাক ক্লাউড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা অতি মাত্রায় দুশনের প্রতীক। এই দূষণ মুলত হয়ে থাকে কৃষি বর্জ্যের মাধ্যমে। পাশাপাশি এটি স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণও। দুর্বল কৃষি ব্যবস্থাপনার কারণে এই সংক্রান্ত সমস্যাকে মিসর সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।

ফারিস ফারাগ অ্যাকুয়াপনিক্সের মাধ্যমে চাষাবাদ করে মরুভুমির দেশে কৃষি ব্যবস্থার এক নতুন দ্বার উন্মোচন করলেন। এই পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রথাগত কৃষি ব্যবস্থার চেয়ে ৯০ শতাংশ কম পানির প্রয়োজন পড়ে। অ্যাকুয়াপনিক্স অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং এতে কৃষি ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সফলতার মূখ দেখা যাবে বলে মনে করেন ফারিস।

মিসর ছেড়ে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে চাষাবাদ ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে পরেছে যেখানে পানির প্রাচুর্য খুব স্বল্প পরিমাণে। আমাদের দেশও এখন এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে খুব সহজেই চাষ করা যায়। দেশের যেসব জায়গায় বছরে অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকে সেসব জায়গায় এই পদ্ধতি অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখবে । দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলতে পারে এই নতুন পদ্ধতির চাষ, শুধুমাত্র প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে তা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics