
ঈদের ছুটিতে ঘোরাঘুরিঃ সাগরে-সৈকতে সতর্ক রইবেন
মোহাম্মদ আরজু
‘সসাগরা পৃথিবী’ বললে পুরোটা বলা হয় না। বলতে হয় আমাদের এই গ্রহ মূলত এক বিপুল মহাসাগর, যার মধ্যে কিছু মহাদ্বীপে আমাদের বাস। এরমধ্যে যারা সাগরের থেকে দূরে থাকেন, তাদের উচিত কাছে যাওয়া। তবেই ‘পৃথিবী’র কাছে যাওয়া হবে। এই ঈদে যারা যাচ্ছেন মহাভারতের মহাসাগরতীরে, বঙ্গোপসাগর ও সৈকতে, তারা ঈদ ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু নিবেদন।
১. যদি কলাকৌশল আয়ত্ত্বে থাকে এবং দরকারি সুরক্ষা থাকে তবে সাঁতার, স্নরকেলিং, ডাইভিং, স্কিয়িং, সার্ফিং, সেইলিং ইত্যাদি জলক্রীড়া করতে ভুলবেন না। সাগরজলে এসব বিনোদন যেমন জমবে, তার তুলনাটি কোথাও পাবেন না। তবে মনে রাখবেন, দরকারি জলকৌশল আয়ত্ত্ব না থাকলে ভুলেও এসবের চিন্তা করবেন না। পাশাপাশি নিশ্চিত হয়ে নিন কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্ধার ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সেবা কাছাকাছি রয়েছে কি না।
২. প্রিয়, মনে রাখবেন, সাগর গোসলখানা নয়। ‘গোসল’ করতে সাগরে নামবেন না দয়া করে। আপনি তো জানেন, সাগরের লোনা জলে আর যা-ই হোক গোসল হয় না। সাগর থেকে ফিরে স্বাদু পানিতেই গোসল সারতে হয়। ফলে কোমর, গলা বা মাথাডুবো পানিতে ডুবাতে সাগরে নামবেন না। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। তবে অবশ্য অবশ্যই সমুদ্রের স্পর্শ নিতে ভুলবেন না। আপনার চরণ অবশ্য ভেজাবেন সমুদ্রজলে। নয়ত আর সমুদ্র যাত্রা কেনো?
৩. জলক্রীড়ায় আপনার পারদর্শীতা যদি না থাকে তবে সৈকতে সময় কাটান, অবকাশ যাপন করুন। ইচ্ছেমাফিক ‘লাফালাফি ঝাপাঝাপি নৃত্য’ করবার নাম জলক্রীড়া নয়, ওটা করবেন না, বেখেয়ালে বেমালুম বিপদ হতে পারে।
৪. যদ দক্ষ জলক্রীড়াবিদ বা সাতারুই হোন না কেনো, সমুদ্র যদি সাঁতরান, সুরক্ষিত থাকুন। ভাটার সময় নামবেন না, ভরপেট খেয়ে নামবেন না, যেখানে নামা নিষেধ সেখানে নামবেন না, সৈকতে পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী সক্রিয় আছেন এটা নিশ্চিত না হয়ে নামবেন না। যত দক্ষ সাঁতারুই হোন না কেন, শরীরের অধিকাংশ যদি জলের নীচে রেখে সৈকতে দাঁড়ান, তবে একটু মাঝারি ঢেউয়েও আপনি ভারসাম্য হারিয়ে ডুবতে পারেন। ‘গোসল করতে নেমে ডুবে মারা’ যারা যান, তারা এভাবেই ডোবেন।
যা উপভোগ করছেন, তা রক্ষা করুন
আপনি যেই সাগরের কাছাকাছি ঘুরতে যাচ্ছেন, সেই সাগরের ওপর নির্ভর করে আপনার ও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান। এখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ, কৃষি, অর্থনীতি ও খাদ্য-পুষ্টির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক বঙ্গোপসাগর।
ফলে সাগরের কাছাকাছি ঘুরতে যাবার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি প্রস্তুত কি না।
যেখানে থাকছেন, খাচ্ছেন

১. ঘুরতে যাবার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে, যেই মনোরম প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে আপনি যাচ্ছেন- আপনার ভ্রমণের কারণে সেই প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। যেই ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে বা যেই হোটেল-মোটেল-কটেজে আপনি যাচ্ছেন তা পরিবেশবান্ধব কি না যাচাই করে নিন।
২. পরিবেশবান্ধব আবাসন যাচাইয়ের প্রধান উপায় সম্পর্কে সচেতন থাকুন। একটি পর্যটন আবাসন বা রেস্তরাঁ ‘পরিবেশ-বান্ধব’ হওয়ার মানে হচ্ছে, স্থানীয় প্রাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বংশ পরম্পরায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে এমন স্থানীয় লোকেদের মালিকানা বা ব্যবস্থাপনা বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সেটি পরিচালিত হচ্ছে।
৩. এমন পরিবেশবান্ধব আবাসন না পেলে চেষ্টা করুন পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে জ্বালানি, জল ও অন্যান্য সেবার ব্যবস্থা করে এমন আবাসন বা রেস্তরাঁ খুঁজে পেতে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি যেমন সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করে এমন প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দিন। যথাসম্ভব কম বিদ্যুত ও স্বাদু পানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানটি সচেতন কি না দেখে নিন।
৪. এসব ব্যবস্থা সম্পন্ন আবাসন না পেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে চেষ্টা করুন অন্তত আন্তরিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে কি না। উপকূলে ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য নানা প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসাই ব্যবহারে ওই হোটেল মোটেল বা কটেক আগ্রহী কি না। যেমন ধরুন, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এর খুবই অল্প মাত্রায় স্বাদু পানির মজুদ গুরুত্বপূর্ণ। যার একমাত্র উৎস বৃষ্টি। বৃষ্টির জল মাটিতে প্রবেশ করে ৬/৭ ফুট পর্যন্ত গভীর বালুর স্তরে জমা হয়। যেই জল গর্ত করে উঠিয়ে সারাবছর কৃষি ও গেরস্থালি কাজে লাগায় স্থানীয়রা। এখন কোনো হোটেল যদি তাদের প্রাঙ্গণের মধ্যে জায়গাগুলো এমনভাবে ঢালাই করে রাখে যে, মাটি চুইয়ে ভেতরে জল যেতে না পারে, তবে তারা কিন্তু বৃষ্টির জল জমার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ঠিকই ভূগর্ভস্থ জল উঠিয়ে ব্যবহার করে পুরো দ্বীপের জন্য সমস্যা তৈরি করছেন। এমন আবাসনে যাবেন না।
৫. খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন যে, আপনার ব্যবহৃত অপচনশীল জিনিসপত্র রিসাইকেল বা পুনঃব্যবহারযোগ্য করতে ওই হোটেলের তরফে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না। তারা সাগরে এসব ফেলা থেকে বিরত থাকে কি না। অযথা বিদ্যুতের বাড়তি ব্যবহার করে এমন আবাসনে যাবেন না।
৬. পরিবেশ-বান্ধু বা পরিবেশ-শত্রু; যেরকম আবাসনেই যান না কেন, শুধু আপনি নিজেই রাখতে পারেন এমন ভূমিকাও রয়েছে। যেমন, কম সময়ে গোসল সেরে নিন এবং ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ রাখেন। যখন আপনি রুমের বাইরে যান তখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, টেলিভিশন, বাতি ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র বন্ধ করে যান। প্রতিদিন বদলের সুযোগ থাকলেও বিছানা ও তোয়ালে পুনরায় ব্যবহার করেন। বাড়তি ও অপ্রজয়োজনীয় ধোয়ার কারণে স্বাদু পানির অপচয় হয়।
৭. পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি উৎসাহিত করতে ভূমিকা রাখুন। তাদের প্রশংসা করুন। পরিবেশ-বান্ধব না হলে, তাদের স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে আসুন, যদিও আপনি সেখানে ছিলেন, কিন্তু এতে আপনি সন্তুষ্ট নন, তাদের উচিত হোটেলটিকে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলা।
যেখানে ঘুরছেন
কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকত।

১. যদি কক্সবাজার সৈকতের কোনো নিরিবিলি অংশে, ইনানী সৈকতের কাছেপিঠে কোথাও, মহেশখালী, সোনাদিয়া বা সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে যান; তবে খেয়াল রাখবেন সন্ধ্যার পর যেন সৈকতে আপনার উপস্থিতির কারণে সামুদ্রিক প্রাণীদের অসুবিধা না হয়। এসব জায়গায় পরিবেশ বিধ্বংসী পর্যটন গড়ে উঠেছে, রাতেও সৈকতে প্রচুর দোকান ও চেয়ার রাখা হয়, অনেক বেশি আলো, ডিজেল জেনারেটরের শব্দ ও লাউড স্পিকারের কান ফাটানো আওয়াজের কারণে সৈকতে ডিম পাড়তে আসা বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা হবেন না।
২. সাগরের কাছাকাছি যখন ঘুরতে যাবেন, পায়ের ছাপ ছাড়া অন্য কিছু ফেলে আসবেন না। সৈকতে অবকাশ যাপন শেষে যখন আপনি ফিরে আসছেন, তখন যেনো আপনার ছাপ ছাড়া আর কিছু ফেলে না আসেন। যা কিছু নিয়ে গেলেন আপনি, যা খেলেন বা ব্যবহার করলেন, সব বর্জ্যই সাথে করে নিয়ে আসবেন। অনেক সৈকতে এসব বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। না থাকলে নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিয়ে আসবেন। অপচনশীল বর্জ্যের কারণে সমুদ্রে দূষণের মাত্রা বাড়ে, জলজ বসতিগুলো সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য অনুপযোগী হয়ে ওঠে। প্রাণীরা মারা পরে।
৩. মনে রাখবেন, মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন সাগরের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, তেমনি পৃথিবীর বিপুল মহাসাগরের সুস্বাস্থ্য অনেকাংশেই নির্ভর করে প্রবাল এর ওপর। পৃথিবীর বিপুল মহাসাগরের ১ শতাংশেরও কম অঞ্চলে রয়ে এই প্রবালের বসতি ও প্রাচীর। বঙ্গোপসাগরেও এমন প্রবাল বসতি রয়েছে অল্প কিছু জায়গায়। সাগরে এরা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ প্রাণের খাবার ও বসতি যোগায়… সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি প্রধান প্রবাল বসতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্থলসীমানার খুব কাছেই সাগরে রয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি বা এনিমেল প্লানেট ইত্যাদি টিভি চ্যানেলে আপনি বিদেশের সাগরতলের যেমন অপরুপ প্রবাল-রাজ্য দেখতে পান। বাংলাদেশেও কমবেশি এমনটি ছিল। এখনো যেটুকু আছে, তা স্বচক্ষে দেখে আসার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হারাবেন না। স্নরকেল ও ডাইভিং করার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।
৪. প্রবাল কেনার অপরাধে জড়াবেন না। দুষ্কৃতিকারীরা এসব বহুবর্ণিল প্রবাল কেটে তুলে নিয়ে আসছে গত দুই দশক ধরে। প্রবালের কঙ্কালটি এসিডে ডুবিয়ে প্রায় সাদা করে ফেলা হয়। যা সুদৃশ্য বস্তু হিসেবে বিক্রি করা হয় পর্যটকদের কাছে। কিন্তু আপনি সতর্ক, আপনি এই অপরাধে জড়াবেন না। প্রবাল হচ্ছে প্রাণী, আনুবীক্ষণিক প্রাণী। এদের নিধন করা বা বেঁচা-কেনা করা বণ্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রবাল কিনবেন না, নিজের ও কোটি মানুষের ভবিষ্যতকে হাতে ধরে খুন করবেন না।