উদ্ভিদজগতে লেন্টিসেল-এর ভূমিকা
জায়েদ ফরিদ
একটি গাছ থেকে যখন কোনো ফল ছিঁড়ে ফেলা হয় তখন সেই ফলকে আমরা কি বলবো, জীবিত না কি মৃত? আর সেই ফলের ভেতরে আছে যে শক্ত কাষ্ঠল বীজ, তা কি মৃত? কিন্তু মৃত হলে তার থেকে জীবিত গাছের অঙ্কুরোদ্গম হবে কিভাবে! অতএব গাছ থেকে আলাদা করে ফেললেও আম, আপেল, বড়ই, নাশপাতি মৃত নয়; মৃত নয় তাদের বীজও। তবে ফলের এহেন বৃক্ষ্যচ্যুত জীবন একটি সীমিত সময় পর্যন্ত, যতদিন গাছের সান্নিধ্য ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারে ততদিন পর্যন্ত। আর না টিকে থাকতে না পারলে সেই তাজা ফল আমাদের খাওয়ার সৌভাগ্য হত কিভাবে, সেটাও ভাবি!
এখন প্রশ্ন হল কিভাবে বেঁচে থাকে এসব বৃন্তচ্যুত ফল? বেঁচে থাকার জন্যে শক্তির প্রয়োজন হয়। এই শক্তির জন্যে চিনি বা শর্করাকে বিশ্লিষ্ট করতে হয়। আর এই কাজ করার জন্যে দরকার হয় অক্সিজেনের। চিনি তো ফলের ভেতরেই মওজুদ থাকে। কিন্তু অক্সিজেন নিতে হয় বাইরে থেকে। এই অক্সিজেন ঢোকার জন্যে ফলের শরীরে থাকে একপ্রকার রন্ধ্র যার নাম লেন্টিসেল বা বায়ুরন্ধ্র। শক্তি উৎপাদনের সময় যে উপজাত কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল তৈরী হয় সেসব নিষ্কাশনের জন্যেও ব্যবহৃত হয় বায়ুরন্ধ্র।
অবিরাম শক্তি উৎপাদন করতে করতে এক পর্যায়ে আম-আপেলের রঙ নষ্ট হতে থাকে। ঘ্রাণ আর স্বাদ অপ্রিয় হতে থাকে। দেহ শুকিয়ে যায়, পচে যায়, অর্থাৎ মরে যায় ফল। কিন্তু আঁটি থাকে তখনো জীবিত। অধিকাংশ ফলের গায়ে লেন্টিসেল স্পষ্ট দেখা না গেলেও কিছু ফলের গায়ে তা বেশ স্পষ্ট। এমন একটি ফল হল আপেল; লাল বা হলুদ আপেল। বায়ুরন্ধ্র নাশপাতির গায়েও দেখা যায় বেশ স্পষ্ট, আর নিত্যিকার আলুর গায়ে যে ফুটকি দাগ দেখা যায় তাও তো লেন্টিসেল-এর কারণেই।
আমাদের দেশে ভারত থেকে কয়েক রকমের আপেল আসে যার মধ্যে দেখা যায় লাল আর হলুদ রঙের দুটি প্রজাতি, রেড ডেলিশিয়াস আর গোল্ডেন ডেলিশিয়াস। যেগুলি স্বাদে-গন্ধে সারা দুনিয়া জুড়ে বিখ্যাত। বিংশ শতাব্দির প্রথম থেকে কাশ্মীর, হিমাচল এবং উত্তর প্রদেশে এগুলোর ফলন শুরু হয়। এই আপেলের গায়ে সাদা বা কালচে রঙের যে ফুটকি দেখা যায় সেগুলোই লেন্টিসেল। এর ভেতর দিয়েই অক্সিজেন ভেতরে প্রবেশ করে, নির্গত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানি। তবে এই ছিদ্রপথ সরাসরি বহির্জগতের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে এর ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এবং ভাইরাস। যে কারণে ফল কখনো বিবর্ণ-বিস্বাদ হয়ে নষ্ট হতে পারে। ফ্রিজে রাখলে ঠাণ্ডায় রন্ধ্র সঙ্কুচিত হয়ে গ্যাস বিনিময় কম হয়, বিপাক ক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যায়, আবার লেন্টিসেলের ভেতর দিয়ে ক্ষতিকর জীবাণুও ঢুকতে পারে কম, তাই ফলও টিকে থাকে বেশিদিন।
একটি ফলের ভেতর লেন্টিসেলের ব্যবহার থাকে সীমিত সময়ের জন্য। কিন্তু গাছের কাণ্ডে এবং শেকড়ে তাদের উপস্থিতি থাকে দীর্ঘকালব্যাপী যা গাছের জীবদ্দশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি গাছের বাকলের বাইরের দিকটা প্রায়শই থাকে মৃত এবং শোলা-ধর্মী যা জল এবং তাপ নিরোধক। কিন্তু ভেতরের দিকটা থাকে জীবন্ত যার ভেতর দিয়ে চলাচল করে শর্করার মতো কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টি। উপরিভাগে থাকলেও ক্ষুধার্থ প্রাণীরা এই ছাল খেতে পারে না। কারণ এখানকার উদ্ভিদকোষগুলির স্বাদ থাকে তিক্ত ও বিষাক্ত। এই বাকলের ভেতর থাকে লেন্টিসেল। যা আর কিছু নয়। পত্ররন্ধ্রের মতো ছিদ্র বিশেষ। প্রভেদ হল, এই রন্ধ্রের আকার পত্ররন্ধ্রের মতো নিয়ন্ত্রিত নয়।
যাবতীয় প্রাণির মতো গাছেরও জীবন ধারণের জন্যে দরকার হয় অক্সিজেনের। পত্র, কাণ্ড, শেকড় সর্বত্রই চাই অক্সিজেন। এই অক্সিজেন গাছ নিজেই তৈরি করে নিতে পারে সবুজ পাতা থেকে, সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে। কিন্তু এই ঘটনা দিনের বেলার, যখন সূর্যরশ্মি থাকে। রাতের বেলা তাদের লেন্টিসেলের মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে হয় বাইরে থেকেই। এখন আমরা ভাবতে পারি, গাছ যদি সেই অক্সিজেন ব্যবহার করে ফেলে নিজেদের জীবিত রাখার তাগিদে তাহলে প্রাণিজগতের জন্যে তারা অক্সিজেন সরবরাহ করে কিভাবে! হ্যাঁ, প্রশ্নটা সমীচীন, তবে তারা যতোটা অক্সিজেন ব্যবহার করে রাতে, দিনের বেলা তৈরি করে দেয় তার দশগুণ।
ঐতিহ্যবাহী সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে এই লেন্টিসেল আরো দেখা যায় ঠেসমূলে এবং শ্বাসমূলে। যখন ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলের এই বনে নদীবাহিত পলিমাটির কারণে চর জেগে ওঠে, তখন প্রথমেই আস্তানা করে ঠেসমূল সম্বলিত গেওয়া গাছ। বনের মাঝখানে লবণাক্ততা কমে এলে সেখানে জন্ম নেয় সুন্দরী গাছ এবং মিঠা পানিতে থাকে অন্যান্য গাছপালা। গেওয়া গাছের শেকড় যদি জলের উচ্চতার ওপরে থাকে, তবে তাতে লেন্টিসেলের পরিমাণ থাকে কম। কিন্তু জলমগ্ন গাছের শেকড়ের উপরিভাগে থাকে প্রচুর লেন্টিসেল। এর ভেতর দিয়ে বায়ু প্রবেশ করে পৌঁছে যায় গাছের সর্বত্র। শ্বাসমূল দেখা যায় অনেক গাছেই। তার মধ্যে বাইন গাছ অন্যতম। এদের জলমগ্ন শেকড় থেকে সরাসরি ওপরের দিকে মাথা বের করে মোচার আকৃতির শেকড় যার ওপরিভাগ থাকে লেন্টিসেল সমৃদ্ধ।
পশ্চিমের দেশগুলিতে বিভিন্ন রকম লেন্টিসেল সমৃদ্ধ গাছগুলিকে অনেক সময় নির্বাচন করা হয় ল্যান্ডস্কেপিং-এর সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে। পাতা ঝরে যাবার পর লেন্টিসেলগুলি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখে। যার মধ্যে রয়েছে উইলো, চেরি, রেড ম্যাপেল, নাশপাতি ইত্যাদি। ছাত্রদের অনেক সময় নিয়ে যাওয়া হয় পত্রমোচী বৃক্ষের বনে যেখানে শুধু লেন্টিসেল দেখে গাছ সনাক্ত করার একটি মহড়া চলে।