উপকূলে পানি ঢাকার চেয়ে দামি
পার্থ শঙ্কর সাহা
গরম এলেই পানি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন খুলনার দাকোপের দীপক রায়। এলাকার নলকূপগুলোতে লোনাপানি ওঠে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় পুকুরগুলোও লোনাপানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।চালনা পৌর এলাকার বাসিন্দা দীপকের পরিবারে চারজন সদস্য। জরুরি কাজের জন্য প্রতিদিন ১২ লিটার পানি কেনেন তাঁরা। এলাকার এক ব্যবসায়ী পুকুরের পানি পরিশোধন করে এক টাকা লিটার দামে বিক্রি করেন। আবার গরমের সময় পানির দাম বেড়ে হয় দুই টাকা। দীপক বললেন, ‘প্রতি ফোঁটা জল মেপে খেতে হয়। অনেক সময় তেষ্টা থেকেই যায়।’উপকূলজুড়েই সুপেয় পানির কমবেশি এ রকম কষ্ট। যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁরা পানি কিনতে বা দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষকে অনিরাপদ নানা উৎস থেকেই পানীয়জল সংগ্রহ করতে হয়।
চালনা পৌরসভার মেয়র অচিন্ত্য মণ্ডল গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌর এলাকায় পানি একটি জমজমাট ব্যবসা। নিরাপদ পানির জন্য সরকারি সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছি। একটি প্রকল্প হওয়ার কথা।’
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছে, চালনায় সুপেয় পানির জন্য ব্যয় রাজধানী ঢাকার তুলনায় ৩৮০ গুণ। চালনায় ব্যক্তি খাত থেকে এক লিটার নিরাপদ পানি কিনতে ব্যয় হয় দুই টাকা ৬৬ পয়সা। ঢাকায় এক হাজার লিটার পানির জন্য ওয়াসার ধার্য মূল্য ৭ টাকা। গবেষণায় পানির দামের সঙ্গে পরিবহন খরচ, পানি পেতে ব্যয় হওয়া কর্মঘন্টার হিসাব যুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, পাইকগাছায় লিটারপ্রতি পানির দাম দেড় টাকা, কলারোয়ায় দুই টাকা ২৫ পয়সা আর কয়রায় আড়াই টাকা।২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চালানো ‘উপকূলীয় এলাকায় পানি নিরাপত্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক ওই গবেষণায় চালনা ছাড়াও খুলনার পাইকগাছা সদর, পুরো কয়রা উপজেলা ও সাতক্ষীরার কলারোয়া সদরের সুপেয় পানির সংকট তুলে ধরা হয়। গবেষণাটির পরিচালক ওয়াটার এইডের গবেষণা ব্যবস্থাপক আফতাব ওপেল।
কয়রায় পানির নিরাপদ উৎস প্রায় সবই অকেজো। উপজেলার ৭৪টি পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ—পুকুর থেকে লোনাপানি ছেঁকে নেওয়ার ব্যবস্থা) ব্যবস্থার মধ্যে এখন ৩১টি সচল আছে। এক লাখের বেশি বাসিন্দার মধ্যে এর মাধ্যমে মাত্র ১০ হাজার মানুষ পানীয়জল পেতে পারে।
পাইকগাছার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে চারটিতে পুরোপুরি এবং দুটিতে প্রায় অর্ধেক গভীর ও অগভীর নলকূপের স্তরে লোনাপানি ঢুকে গেছে। পুরো শহরে মূল ভরসা একটিমাত্র পুকুর। আর্সেনিক ও আয়রনমুক্ত পানির জন্য দুটি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে বেসরকারি খাতে। তবে শুধু সচ্ছলরাই সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে।
চালনা পৌর এলাকার নিম্নবিত্ত মানুষের গড় আয় ছয় হাজার টাকা। পরিবারের গড় সদস্য ৩ দশমিক ৯৭ জন। মাথাপিছু তিন লিটার ধরে পরিবারের প্রায় চার সদস্যের জন্য মাসে পানির চাহিদা ৩৫৭ দশমিক ৩ লিটার। বাড়তি দামে কিনতে হলে এ ধরনের একটি পরিবারে মাসিক পানির ব্যয় হবে তাদের আয়ের প্রায় ১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দলিলে বলা হয়েছে, এ দুই খাতে পরিবারপিছু ব্যয় কখনোই আয়ের ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
গবেষণাটির কথা জানালে অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান বলেন, এই চিত্র বলে দিচ্ছে, এসব অঞ্চলে সরকারের বিনিয়োগে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। নাজুক এ অঞ্চলে যে উদ্যোগ ও বিনিয়োগ দরকার, তা অবশ্যই করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বললেন, সরকারের চেষ্টা আছে। নিরাপদ পানির সংস্থান না করতে পারার মূল কারণ সরকারের সীমাবদ্ধ সম্পদ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান পানির জন্য উপকূলের মানুষের এত বেশি ব্যয়কে চরম বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যে ধনীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে, পানির দামের এই বৈপরীত্য সেটি প্রমাণ করেছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন খুলনা প্রতিনিধি সুমন্ত চক্রবর্তী)
আজ বিশ্ব পানি দিবস: আজ বিশ্ব পানি দিবস। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে পানি ও জ্বালানির মধ্যকার সম্পর্ক। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এ উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রে রয়েছে পানির প্রাপ্যতা। বাংলাদেশে দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আজ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (২২/৩/২০১৪)