এটা গল্প হলেও তো পারতো !!!

 

এক সপ্তাহের ওপর হল রাফাতের জ্বর। ডাক্তার সন্দেহ করছেন টাইফয়েড, আজই ফাইনাল রিপোর্ট আসার কথা। ভার্সিটির ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে ওর রুমে ঢুকলাম। বেচারা মুখ কালো করে চুপচাপ শুয়ে আছে। কিরে? মন খারাপ? জ্বর কি খুব বেশি? আমার এতগুলো প্রশ্নের একটাই উত্তর আসে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে- হুমমম! আমি অবশ্য ওর পাশেই বসে থাকি, এখন পাত্তা না দিলেও একটু পর নিজেই কথা বলবে। ঘটলও তাই, অনেকক্ষণ পর তার মুখ দিয়ে কথা বেরোল- পরশু সব বন্ধুরা পিকনিকে যাচ্ছে, আর আমার এই অবস্থা।

আচ্ছা আপি, অসুখ বিসুখ আমাকে এত ভালবাসে কেন রে? এখানে তোর কোন দোষ নেই, তোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আমাদের দেহের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এর কাজ অনেকটা প্রতিরক্ষা বাহিনীর মত। যখনই দেহে কোন ক্ষতিকর কিছু প্রবেশ করে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেটা ধ্বংস করে দেয়। তোর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তোর মত ফাঁকিবাজ, ঠিকমত কাজ করে না, তাই শুধু অসুখে পরিস। আমার কথা শুনে ওর মন হয়তো আরো খারাপ হয়ে গেল। মুখ দেখে অন্তত সেরকমটাই মনে হল। ওর মুড চেঞ্জ করার জন্য বললাম- গল্প শুনবি? রাফাতের সাদাসিধে উত্তর, সেই ছোট থাকতে না হয় রূপকথার গল্প শুনতাম। এখন তো বড় হয়েছি, কী গল্প শোনাবি? আমি বললাম, ঠিক গল্প না, বাস্তবেই ঘটেছে এই কাহিনী। শুনেই দেখনা! ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি শুরু করে দিলাম।

গল্প বলতে আমার খুব ভাল লাগে, সুতরাং এ সুযোগ আর হাতছাড়া করা যায় না। বছর চল্লিশেক আগের কথা। ১৯৭১ সালে টেক্সাসে ডেভিড ফিলিপ ভেল্টার নামে একটা শিশুর জন্ম হয়। তবে তার জন্মটা অন্যসব শিশুদের মত সাধারণ ছিল না- SCID বা Severe combined Immune deficiency এ আক্রান্ত ছিল সে। অর্থাৎ তার দেহে কোন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ছিল না। ভেল্টার পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান- ডেভিডের বড় ভাই- মাত্র সাত মাস বয়সেই এ রোগে মারা যায়। ডেভিডের যেন একই পরিণতি না হয় তার জন্য একমাত্র আশার আলো ছিল বড় বোন ক্যাথেরিনের বোনম্যারো ডেভিডের শরীরে প্রতিস্থাপন করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু’জনের বোনম্যারো ম্যাচ না করায় সেটাও সম্ভব হয়নি। তাহলে? তারপর কী হল? রাফাতের চোখে-মুখে বিস্ময়। ওর মুখের এই এক্সপ্রেশানটা আমার খুব মজার লাগে। তাহলে আর কি? ডেভিডের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নেই, বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিরও উপায় নেই, সুতরাং রোগ-জীবাণু থেকে দূরে রাখাটাই ছিল তাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায়।

david

তার জন্মের পর পরই তাকে প্লাস্টিকের তৈরি একটা চেম্বারে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এই প্লাস্টিক চেম্বারের মধ্যে তার কাপড়, খাবার, পানি সবকিছুই জীবাণুমুক্ত করে দেওয়া হত। এমনকি তাকে স্পর্শ করা হত সেই চেম্বারের দেয়ালে লাগানো প্লাস্টিকের গ্লাভস দিয়ে। সেই প্লাস্টিকের “বাবল” থেকেই তার নাম হয়ে গেল “বাবল বয়”। আহারে বেচারা! রাফাতের মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হল একটা। এরকম অস্বাভাবিক জীবন কীভাবে সম্ভব? আমি আবার বলতে শুরু করলাম, ডেভিডের বাবা, মা, তার ডাক্তার, মেডিকেল টিম- সবাই তাকে একটা স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম দিকে ডেভিডের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল হসপিটালের ঐ প্লাস্টিক চেম্বারটাতে। পরবর্তীতে তার বাড়িতে ঠিক অনুরূপ একটা প্লাস্টিক চেম্বার তৈরি করে হসপিটালের চেম্বারটার সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়, যাতে সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটাতে পারে। তার বিনোদনের জন্য টেলিভিশন আর প্লে রুমের ব্যবস্থাও করা হয়। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল তার প্রতিবেশী শন। তারা একসাথে খেলা করতো, টেলিভিশন দেখতো আর অপরিচিত নাম্বারে ফোন করে দুষ্টুমি করতো।

অন্যান্য বাচ্চাদের মত স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ তার ছিল না, তাই স্কুলের টেলিফোনের মাধ্যমে পড়াশোনা শিখতো, বাবার কাছ থেকেও নতুন নতুন শব্দ শিখতো সে। তার ছোট্ট বাবলের ঘরের ভেতর থেকেই মায়ের ঘরোয়া কাজে সাহায্য করতো। আর ওর বোন? ক্যাথেরিন? রাফাতের প্রশ্ন। বোনের সাথে বেশ সুসম্পর্ক ছিল তার। তবে মাঝে মাঝে টেলিভিশন দেখা নিয়ে ওর সাথে ঝগড়াতেও মেতে উঠত সে। দুই ভাই বোনের খেলা শেষে ক্যাথেরিন ভাইয়ের বাবল চেম্বারের পাশেই ঘুমিয়ে পড়তো। একদিন ঘরের জানালা আর টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে দেখা পৃথিবীকে আরও কাছ থেকে দেখতে চাইল ডেভিড। ১৯৭৭ সালে নাসার কিছু গবেষক তার জন্য স্পেসস্যুটের মত একধরণের বিশেষ স্যুট তৈরি করেন। এটা পরে সে সুরক্ষিত অবস্থায় পৃথিবীটাকে আরো কাছ থেকে দেখতে পায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এরকম বন্দী জীবনযাপন করা ডেভিডের জন্য ক্রমেই অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
PA-19122708

১৯৮৩ সালে বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়- সম্পূর্ণ ম্যাচ না হওয়া সত্ত্বেও বোনম্যারো প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার মানে তার বোনের বোনম্যারো ডেভিডের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল? রাফাত তখন খুব খুশি। একটা happy ending এর প্রতীক্ষায় সে। হ্যাঁ, সম্ভব হয়েছিল। সেবারের বড়দিনে ক্যাথরিনের বোনম্যারো ডেভিডের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। কিন্তু এর একমাসের মধ্যেই অপ্রত্যাশিতভাবে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তাকে বাবল থেকে বের করে চিকিৎসাধীন করা হয়। এই প্রথম ডেভিডের মা তাঁর সন্তানকে নিজ হাতে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী মাত্র ১২ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যায় ডেভিড। পরবর্তীতে জানা যায়, বোন ক্যাথেরিনের বোনম্যারোতে থাকা Epstein Barr Virus তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল।
furnel

এ পর্যন্ত শুনে রাফাত যেন একটা শক খেলো, কিছুই বলল না। চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল। একটা মজার ব্যাপার কি জানিস রাফাত? নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমি বলে উঠলাম- তার এই ১২ বছরের জীবনে ডেভিড নিজেকে কখনোই অসহায় বা প্রতিবন্ধী ভাবে নি, কখনোই প্রশ্ন করেনি- আমিই কেন! ভাল থাকার সবচেয়ে ভাল উপায় কী জানিস? চারপাশের মানুষগুলোকে দেখবি ভালোমত, দুনিয়ার মানুষগুলোর সমস্যার অন্ত নেই। অনেকের থেকে ভালো আছিস তুই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলাম আমি। ততক্ষণে ওর রিপোর্ট চলে এসেছে। নাহ, টাইফয়েড না। বাঁচা গেল। খোঁচা দেওয়ার মোক্ষম সময় এটাই- ওঠেন ওঠেন, আর ঢং করা লাগবে না। কিচ্ছু হয়নাই আপনার! রাফাতের মুখে ম্লান হাসি। এখনও কী যেন ভাবছে ও। হয়তো বাবল বয়ের কথাই ভাবছে। হয়তো ভাবছে- এটা গল্প হলেও তো পারতো!

সাবেরা সায়মা 

অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আরো দেখান

Related Articles

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics