কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে ৪০ বছরে সবচেয়ে বড় ধ্বসঃ হুমকির মুখে চার লাখ মানুষের জীবন
রাযীন আশরাফ
বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে বড় কোন অর্জন না এলেও এদেশের অর্থিনীতে পর্যটন শিল্প বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা আসলেই সবার আগে যে নামটি উঠে আসে তা হল কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত। প্রতিবছর ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে প্রকৃতি প্রেমিক ও পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর এই দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকত। কিন্তু এবছর এই চিত্র একেবারে ভিন্ন। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় হুমকীর মুখে পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। হোটেল এবং পর্যটন ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক অবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
প্রতি বছরই নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই চার মাস পর্যটকদের ভিড় এই সমুদ্র সৈকতের একটি পরিচিত চিত্র। বিশ্বের এই দীর্ঘ সমূদ্র সৈকতে দেশের ও বিদেশের সকল প্রান্তের কম বেশি সকল শ্রেনী পেশার মানুষ এই মৌসুমে এসে জড়ো হয়। কিন্তু এবার দেশের মানুষের অবকাশ যাপনের মূল জায়গার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। দেশের পর্যটন শিল্পের অন্যতম এই স্থান আজ প্রায় ফাঁকা। বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি আজ দেশি পর্যটকেরও বড় শূন্যতা দেখা দিচ্ছে এই সমূদ্র সৈকতে। যার ফলে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন।
অন্যদিকে হোটেলগুলো তাদের লোকসানের দোহাই দিয়ে কর্মচারীদের ছাটাই করতে শুরু করেছে, এমনকি যারা চাকুরীতে রয়েছে তারাও চাকরী হারানোর আতংকে রয়েছে। হোটেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে এবং চলমান রাজনৈতিক সংকট না কাটলে তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। কক্সবাজারের হোটেল সি-গাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ ইমরুল ইসলাম সিদ্দিকী জানান, “আমরা ২০০২ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করছি, কিন্তু ব্যবসায় এধরনের মন্দা আগে কখনো হয় নি। একটানা অবরোধ, হরতাল এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারনে কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলগুলোর ব্যবসায় চরম মন্দা চলছে”। তিনি আরো বলেন, “চলমান পরিস্থিতিতে হোটেল মালিকরা লোকসানের মুখে পড়লেও এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কর্মচারীরাও। অনেক হোটেল মালিক তাদের কর্মচারীদের কাজের অভাবে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন, আবার অনেক হোটেল আয়ের অভাবে কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করতে পারছে না”।
কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলের কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে পর্যটনের এই মৌসুমে দেশি বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। ইতিমধ্যেই তাদের অনেক লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরুপ রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে তাদের লোকসান আরো বাড়তে পারে। কক্সবাজারের মার্মেইড ইকো রিসোর্টের ব্যবস্থাপক কাজী অনুর বলেন, “পর্যটনের এই মৌসুম অনেকটাই খালি পড়ে আছে এই রিসোর্ট; বাতিল হয়ে যাচ্ছে আরো অনেক বুকিং”। তিনি যোগ করেন, “ডিসেম্বর মাসটা আসলে আমাদের সুপার পিকের মধ্যে পড়ে। ৩১ ডিসেম্বরেরে জন্য দু’মাস আগে থেকেই যেখানে কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত ভরে যায় সেখানে এই বছর কোনো রিজার্ভেশনই ছিল না। আমার রিসোর্ট প্রায় পুরোটাই বুক করা ছিল কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারনে প্রায় সবগূলো বুকিংই বাতিল হয়ে গিয়েছে”।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে অধিকাংশ পর্যটকই এই স্থানে আসা হুমকী মনে করছেন। নভেম্বর মাসে ১২ দিন অবরোধ ছিল এবং ডিসেম্বরে ছিল মোট ১৩ দিন। অবরোধে ঢাকার সাথে সারাদেশের নৌ, রেল ও স্থলপথের যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বেশির ভাগ পর্যটক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারছেননা এই মনোরম সৈকতে। কক্সবারারের হোটেল কক্স টুডের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক মাইনুদ্দিন খান খোকন বলেন, “অন্যান্য সময় এ বছরটাতে ৮০ শতাংশ রুম বুকিং দেয়া থাকতো, কিন্তু এ বছরের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখের পর থেকে মাত্র ১০ টি রুম ভাড়া হয়েছে”। তিনি আরো জানান, একটি বিলাসবহুল হোটেল চালাতে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ কোটি টাকার মতো খরচ হয়। এ পর্যন্ত ৩০০ কর্মীর মধ্যে ৫০ জনকে বাধ্যতামুলক ছুটি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সচিব আবুল কাশেম শিকদার এক সংবাদপত্রকে জানান, অন্যান্য বছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারীতে গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ পর্যটক ছুটি কাটাতে আসতেন কিন্তু এই বছর তা ১ হাজারে নেমে এসেছে। তিনি আরো বলেন , শুধুমাত্র পর্যটকেরা নন, কর্পোরেট ক্লায়েন্টরাও তাদের বুকিং বাতিল করেছেন। এদিকে পর্যটক না থাকায় কক্সবাজার শহর এবং সমূদ্র পাড়ে অবস্থিত মার্কেটগুলোর অবস্থাও করুন। এদের ক্রয়-বিক্রয় প্রায় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে এমন অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা ব্যাংক এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাদের জীবনও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সালামত উল্লাহ খান বলেন, “বিগত ৪০ বছরের ইতিহাসে পর্যটন ব্যবসার সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে এবার”। তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান যাতে সরকার পর্যটন ব্যবসায় জড়িতদের লোকসান কমাতে বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করার ব্যবস্থা করে।
বলা বাহুল্য যে, ২০১২ সালে এই শিল্পে আয় হয়েছিল প্রায় ১৯ হাজার তিনশ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। কক্সবাজারে কমপক্ষে ৩৫০ টি হোটেল-মোটেল এবং গেষ্ট হাউজ রয়েছে এবং এখানকার পর্যটন শিল্পের সাথে অন্তত তিন লাখ লোক সরাসরি জড়িত রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা চলতে থাকলে এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা শুধু স্থবিরই হবেনা বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তা এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।