কুলসুমের কেঁচোর সংসার

প্রকৃতির লাঙল বলে পরিচিত কেঁচো। জমির উর্বরতা বাড়াতে কেঁচোর অনেক অবদান।
চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের কাছে কেঁচোর কদর কমে গেছে। তবে এই কেঁচোই আবার নতুন করে গরিবের বন্ধু হয়ে উঠছে। যার প্রমাণ মিলেছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সখীপুর গ্রামে।2013-03-01-19-53-54-5131075296735-untitled-12
এই গ্রামের অনেকেই কেঁচো চাষ করে সার বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই জৈবসার ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজিও উৎপাদন করা হচ্ছে গ্রামটিতে। আর এটা শুরু হয়েছে এই গ্রামেরই স্কুলছাত্রী কুলসুম খাতুনের হাত ধরে। গ্রামটির অনেকেই এখন অভাব দূর করেছেন এই কেঁচো সার তৈরি করেই।
কষ্টের অতীত: কুলসুমেরা পাঁচ বোন। বাবা রবি আলম অন্যের জমিতে কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালান। এ আয় দিয়ে একবেলা খাবার জোটে তো অন্য বেলা উপোস থাকতে হয়। ২০০৯ সালে সপ্তম শ্রেণীতে উঠলে অভাবের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কুলসুমের। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামের এক বাড়িতে ঝিয়ের কাজ শুরু করে সে।
বিষয়টি কুলসুমের সহপাঠীদের মুখে শুনে চতরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাইদুজ্জামান কুলসুমের বাড়িতে যান। বাবা-মাকে বুঝিয়ে কুলসুমকে ডেকে নেন। নিজের টাকায় বই-খাতা, জামা কিনে দেন। পরামর্শ দেন, স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) অধীনে বিষমুক্ত সবজি চাষ ও কেঁচো সার তৈরির কৌশল শিখে নেওয়ার। ওই পরামর্শ মনে ধরে কুলসুমের পরিবারের। পরামর্শমতো কাজ করার প্রতিজ্ঞা করে কুলসুম।
শুরুর কথা: এনজিওতে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করে কুলসুম। বাড়ির একপাশে চালা তুলে সেখানে চারটি রিং বসানো হয়। সকাল-বিকাল মাঠে ঘুরে তাজা গোবর সংগ্রহ করে রিংগুলো ভরিয়ে তোলার পর ওই সংস্থার কাছ থেকে ৬০০টি বিশেষ প্রজাতির কেঁচো এনে রিংয়ের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হয়। তিন মাসে চারটি রিং থেকে প্রায় ২০০ কেজি কেঁচো সার পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ৬০০টি কেঁচোর বাচ্চাও পাওয়া যায়। সার ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় তিন হাজার টাকা। কেঁচো বিক্রি করে পায় ৬০০ টাকার মতো। এ আয় কুলসুমের চোখ খুলে দেয়। ইট দিয়ে পাকা গর্ত নির্মাণ করে কেঁচো সার তৈরি শুরু করে সে। মেয়ের সঙ্গে বাবা রবি আলম লেগে পড়েন।
২০০৯ সালে সার, কেঁচো বিক্রি করে সব মিলিয়ে মোট ২৩ হাজার টাকা জমা করেন। এ টাকা দিয়ে অন্যের ৮০ শতক জমি বর্গা নিয়ে কেঁচো সার দিয়ে শসা, লাউ, শিম, করলা চাষ করেন। বিক্রি করে আয় হয় ৭০ হাজার টাকা। এভাবে আয় বাড়ে, চাষের জমি বাড়ে। সার, কেঁচো ও সবজি বিক্রির টাকায় কেনেন ২৬ শতক জমি। বানান টিনের বাড়ি, কেনেন দুটি হালের বলদ, চারটি গাভি। এখন এগুলোর সঙ্গে আছে ২০০ মুরগি ও ১০টি ছাগল। পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে কুলসুম। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তার বোন আয়শা ষষ্ঠ শ্রেণীতে, রোকেয়া পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা।
কুলসুমের গ্রামে: পীরগঞ্জ সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে কুলসুমদের গ্রাম সখীপুর। উপজেলা সদর থেকে পাকা সড়ক ধরে সখীপুরে কুলসুমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সে কয়েকজনকে সার তৈরির কৌশল শেখাচ্ছে। সেখানেই নিজের কথা জানাল কুলসুম।
অভাব তাড়িয়েছে যারা: সখীপুর গ্রামের দিনমজুর মোসলেম উদ্দিনের মেয়ে মোসলেমা খাতুন কুলসুমের পরামর্শে কেঁচোর সার তৈরি ও সবজি চাষ করে গত দুই বছরে ৭০ হাজার টাকা আয় করছেন। এ টাকায় ৫০ শতক জমি বন্ধক নিয়েছেন। সেখানে এবার লাউ ও শিমের চাষ করেছেন। মোসলেমা জানান, আগে খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হতো। এখন সে অবস্থা নেই। তিনটি গাভি কেনা হয়েছে। বাড়ির সামনেও করা হয়েছে সবজির বাগান।
চতরা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুলতানার বাবা মজনু মিয়া চার বছর আগে মারা যাওয়ার পর তাকে প্রায় উপোস থাকতে হতো। কেঁচো সার তৈরি শুরু করে সেও এখন স্বাবলম্বী। একইভাবে সখীপুর গ্রামের শামিমা আক্তার, বিপাশা খাতুন, সারমিন বেগম, ফারহানা খাতুন, লুনা আক্তার, মেরিনা খাতুন, সুমনা আক্তার, মনিকা খাতুন কেঁচো সার তৈরি ও বসতভিটায় বিষমুক্ত সবজির চাষ করে লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছে।
কৃষক হাসমত আলীও তিন মাস পর পর ৯০০ কেজি করে সার তৈরি করছেন। এ সার তৈরির ফলে এখন আর ফসলের খেতে তেমন রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে না। তিনি জানান, আগে গরুর গোবর বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করত। কেঁচো সার তৈরি শুরু করায় বাড়ির পরিবেশও ভালো থাকছে। সবজির ফলন ভালো হচ্ছে। সহজে প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামের অনেকেই লাভবান হচ্ছেন।
গ্রামের কৃষক মনছুর ইসলাম জানান, এক শতক জমিতে পাঁচ থেকে ছয় কেজি করে কেঁচো সার ব্যবহার করলে জমির উর্বরতা অনেক বেড়ে যায়। ফলন ভালো হয়।
তাঁরা যা বলেন: চতরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুজ্জামান জানালেন, ‘অভাবের কারণে যে মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই মেয়েটিই এখন সহপাঠীদের কেঁচো সার ও সবজি চাষের পরামর্শ দিয়ে স্বনির্ভর করে তুলছে। তার প্রচেষ্টায় আমাদের স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী কেঁচো সার ও সবজি চাষ করে লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছে। এটা আনন্দের বিষয়।’
পীরগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘সখীপুর গ্রামের প্রতিটি পরিবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কেঁচো সার তৈরি করছে। অন্য গ্রামের কৃষকদেরও আমরা এ সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি। এ সার জমির উর্বরতা ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়। এ সার ব্যবহার করলে বাম্পার ফলন মেলে। উৎপাদিত ফসলের গুণগত মানও ভালো হয়।’

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-02/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics