গণি টাইগার

সুন্দরবনে বাঘ-আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করেন ওসমান গণি। তাই সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামবাসী তাঁকে চেনে গণি টাইগার নামে। কেবল বাঘের মুখ থেকে মানুষকে উদ্ধারই নয়, বাঘ ও সুন্দরবন রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এই তরুণকে নিয়ে এবারের মূল রচনা।

নদীর বুকে মাত্র সূর্যটা ডুব দিয়েছে। সুন্দরবন দাঁড়িয়ে আছে শিহরণ জাগানিয়া নির্জনতা নিয়ে। সেই নির্জনতা খানখান করে ভেঙে গেল পুবপাড়া থেকে ভেসে আসা বিলাপ ধ্বনিতে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিল জামতলা রানী নামের একটি ট্রলার। সেখানে বসে গল্প করছিলেন তিনজন মানুষ। বিলাপ ধ্বনি শুনে তিনজনের দলটা দাঁড়িয়ে গেল ঝট করে। কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করল বিলাপের অর্থ। অর্থ বুঝতে না বুঝতেই একজনের মুঠোফোনে বেজে উঠল যান্ত্রিক আওয়াজ। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল সাহায্যের আকুতি, ‘গণি ভাই, মজিদরে মামা ধরে নিয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি আসেন।’ সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগারকে ‘মামা’ নামে সম্বোধন করাই নিয়ম।gani
ট্রলার থেকে লাঠিটি হাতে তুলে নিলেন ওসমান গণি। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কালিঞ্চি গ্রামের সবাই তাঁকে চেনে ‘গণি টাইগার’ নামে। বাকি দুই সহচরও ছায়ার মতো অনুসরণ করলেন তাঁকে। বাঘ-আক্রান্ত মজিদের বাড়ি বুড়িগোয়ালিনীতে। প্রথমে সেদিকেই রওনা হলো দলটা। বাড়ির লোকজনকে সান্ত্বনা বাদে আর কিছু দেওয়ার নেই আপাতত। সুন্দরবনের ভেতরে ততক্ষণে আঁধার বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। বনবিবির নাম নিয়ে সামনে এগোলেন গণিসহ বাকি দুজন। পেছন পেছন কানেস্তারা আর মশাল হাতে ছুটে এলেন বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী। গণিরা এগোতে লাগলেন হাতের লাঠিটি দিয়ে আশপাশের গাছগুলো আঘাত করতে করতে। গাছের শরীরে আঘাতের ফলে যে শব্দ হয়, তাতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় এলাকাটা কতটা নিরাপদ। কেবল লাঠির আঘাতেই নয়, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন তাঁরা। উচ্চ স্বরে ডাকতে লাগলেন অভাগা মজিদকে। মজিদের কোনো সাড়া নেই। লাঠির আঘাত আর চিৎকার হারিয়ে যেতে লাগল সুন্দরবনের নিঃসীম নির্জনতার বুকে। বনের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন গ্রামবাসী আর মজিদের স্বজনেরা।
সামনে এগোতে এগোতে চারপাশে নজর রাখলেন তিনজনই। কিছুদূর এগোনোর পর হঠাৎ একটা হেতাল ঝোপে চোখ আটকে গেল ওসমান গণির। টর্চের আলোয় বোঝা গেল টাটকা রক্ত ঝরছে পাতা থেকে! আরও সতর্ক হয়ে গেল দলটি। লাঠি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল আশপাশের গাছপালা, ঝোপঝাড়ে। হেতাল ঝোপটা বাঁয়ে রেখে সামনে আরও ১০ পা এগোতে না-এগোতেই ভেসে এল মৃদু গোঙানি! মজিদ বেঁচে আছে! টাইগার গণি জানেন, আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ করছে বাঘ মামা। তাই শিরদাঁড়া টানটান করে নজর বোলালেন চারপাশে। দলের বাকি দুজনও সমান সতর্ক। আবারও চিৎকার আর লাঠি দিয়ে শব্দ করতে করতে মজিদের সামনে গেলেন তাঁরা। বাকি দুজনকে চারপাশে নজর রাখতে বলে মজিদকে কাঁধে তুলে নিলেন গণি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মানুষটা। মুহূর্তেই রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলেন গণি নিজেও। দ্রুত বেরিয়ে এলেন সুন্দরবনের পেট থেকে। ২০০৯ সালের এ ঘটনায় মৃত্যুকে একদম কাছ থেকে দেখেছিলেন মৌয়াল মজিদ।
gani 1
বাঘের মুখ থেকে
এমন ঘটনা অনেক আছে ওসমান গণির জীবনে। আগেই বলা হয়েছে, সবাই তাঁকে চেনে গণি টাইগার নামে। গণির সঙ্গে আমাদের কথা হলো ঢাকায় বসে। প্রথম প্রশ্ন ছিল, আপনাকে কেন সবাই গণি টাইগার নামে ডাকে। প্রায় ৩৫ বছর বয়সী মানুষটির ঠোঁটে মৃদু হাসি, ‘এটা তো আমি ঠিক বলতে পারি না। তবে সবাই আমাকে ভালোবেসে এই নাম দিয়েছে। বাঘে আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করি আমি। অনেকেই হয়তো বেঁচেও যায় এর ফলে। আর সুন্দরবনে বাঘ আক্রমণ করলে আক্রান্ত মানুষটা উদ্ধার করার সাহস থাকে না কারোরই। আমি এবং আমার দল সেটা করি। ফলে সবাই আমাদের ভালোবাসে।’
ওসমান গণি কাজ করেন ওয়াইল্ড টিম নামের একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে। সংস্থাটির ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিমের দলপতি হিসেবে যোগ দিয়েছেন ২০০৭ সালে। এর পর থেকে প্রায় ১০০ জন মানুষকে উদ্ধার করেছেন গণি। যাঁদের অধিকাংশই প্রাণ হারিয়েছেন শেষমেশ। তবে বেঁচে ওঠার সংখ্যাটাও কম নয়।
এলাকাবাসী কী বলে ওসমান গণি সম্পর্কে? কেন তারা তাঁকে গণি টাইগার নামে ডাকে? প্রশ্নের জবাব মিলল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের আবুল হোসেনের কাছে, ‘বাঘে ধরলে নিজের ভাই পর্যন্ত ভয় পায় ভাইকে উদ্ধার করার জন্য। আমার নিজের ভাগনি ও দুলাভাইকে বাঘে ধরেছিল। আমরা সামনে যেতে পারি নাই। কিন্তু গণি টাইগার গিয়েছে। বলতে গেলে প্রায় বাঘের মুখ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে!’
বাঘের মুখ থেকে লাশ ছিনিয়ে আনা—আসলে কি তেমনটাই ঘটে? গণি বললেন, ‘ঠিক বাঘের মুখ থেকে লাশ ছিনিয়ে আনা বলা ভুল। এটা অসম্ভব। তবে বাঘ তার শিকারের আশপাশেই থাকে। আমরা হয়তো দেখি না, কিন্তু বুঝতে পারি। ওই অবস্থায় আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করা খুব কঠিন। জানের মায়া তো ত্যাগ করতেই হয়।’ কিন্তু কেন এত ঝুঁকি নেন? গণি শোনালেন আরেক গল্প, ‘২০০৭ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। আমি ছিলাম মৌয়াল। নয়জনের একটা দল ছিল আমাদের। একদিন কী মনে করে দলের সঙ্গে না গিয়ে যাত্রা দেখতে গেলাম। বিকেলের দিকে হঠাৎ শুনি, আমাদের দলটাকে বাঘ আক্রমণ করেছে। গিয়ে দেখি একজন জায়গায় মারা গেছেন, আরেকজন গুরুতর আহত। তখন ওয়াইল্ড টিমের কয়েকজন গেলেন আমাদের সাহায্য করতে। তাঁরা বোঝালেন কী করে সাবধান থাকা যায়। কী করে উদ্ধার করা যায় আক্রান্ত মানুষকে। সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও মানুষের সেবা করব। কাজটা অনেক কঠিন, কিন্তু মানুষকে সাহায্য করার যে আনন্দ, তার কোনো তুলনা নাই।’

সুন্দরবনের ছেলে
শাহীন ও মুক্তা নামের দুই ছেলে-মেয়ের বাবা ওসমান গণি। ছেলে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। বাবা যে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, তাতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আপত্তি নেই তাদের মায়েরও। শাহীন তো এরই মধ্যে বন্ধুদের শেখাতে শুরু করেছে, ‘সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো।’ ওসমান গণিও এটা বিশ্বাস করেন মনে-প্রাণে। গ্রামবাসীকে বোঝান এই কথাটা। তারাও আস্তে আস্তে এখন উপলব্ধি করে, সুন্দরবন ভালো থাকলে ভালো থাকবে তারাও। আর ওসমান গণি ও তাঁর দল কেবল বাঘ-আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধারই করেন না; গ্রামে বাঘ ঢুকলে সেটিকে আঘাত না করে বনের ভেতরে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটিও করেন নিপুণ দক্ষতা ও সাহসিকতায়।

সূত্রঃ প্রথম আলো, অন্য আলো, ২৯,০৩,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics