গমচাষে ঝুঁকছেন কৃষক, বোরোর আবাদ কমছে

ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে কৃষক এবার গমচাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তারা বোরোর আবাদ কমিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন গমচাষ। উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশেই এবার গমের চাষ বেড়েছে, কমেছে বোরোর আবাদ। দেশজুড়ে এখন সোনারঙা গমের ছড়াছড়ি। মাঠ থেকে ইতোমধ্যে গম তোলা শুরু হয়েছে। ফলন ও বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষকের মুখে এখন প্রশান্তির হাসি।

pabna-photo
লাভের আশায় গম চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ বছর উৎপাদন ল্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় সোয়া আট লাখ টন গম উৎপাদন হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।

উত্তরের কৃষকেরা জানিয়েছেন, প্রতি বছরই বোরো চাষে লোকসানের ভয় থাকে। ফলন ভালো হলেও মওসুমে ভালো দাম না পাওয়ায় উৎপাদন খরচ ওঠে না কখনও কখনও। বোরো চাষ করে তিন বছর ধরে লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে কৃষকেরা বোরো চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। গত দুই বছরে এ অঞ্চলে বোরো আবাদ কমেছে প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টরে। অথচ গমচাষে কৃষকের লোকসানের ভয় তো নেই-ই বরং লাভ হচ্ছে। এ অঞ্চলে বিঘায় ছয় থেকে সাড়ে আট মণ পর্যন্ত গমের ফলন হচ্ছে। উৎপাদন খাতে বিঘাপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচের পরও এতে কৃষকের নিট লাভ থাকছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক ফসল উৎপাদন ল্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে গম উৎপাদন হওয়ার কথা তিন লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৩৬ হাজার টন। যদিও গমের উৎপাদন ল্যমাত্রা গতবারের চেয়ে এ বছর কিছুটা বেড়েছে। গত বছর ছিল ৩.৭৫ লাখ হেক্টর জমিতে ৯.৭৫ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদন ল্যমাত্রায় সারা দেশে গমের জমির পরিমাণ বেড়েছে ১২ হাজার হেক্টর আর উৎপাদন ল্যমাত্রা বেড়েছে ৪১ হাজার টন। গত বছর হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ২.৭৮ টন আর চলতি বছর হেক্টরে গড় উৎপাদন ধরা হয়েছে ২.৮০ টন।

কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত ২০১০-১১ অর্থবছরে উত্তরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। ল্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছিল প্রায় ১৭ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এ বছর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় ১৬ লাখ ১২ হাজার ৪৯২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এক দিকে সেচের তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, হাল চাষ শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি, সার কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি এবং অন্য দিকে ধান-চালের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকেরা বোরো আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে কমে গেছে বোরোর আবাদ। সরকারি হিসাবে বোরো আবাদ কমেছে ৬২ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে। তবে কৃষক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদদের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, গত দুই বছর আগের চেয়ে এবার বোরো চাষ কমেছে প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে। ২০১০-১২ অর্থবছরে ল্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। আর এ বছর ল্যমাত্রার চেয়ে কম অর্থাৎ প্রায় ১৫ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদ হয়েছে।

অপর দিকে গম আবাদে সেচ কম লাগার কারণে বরেন্দ্র ও চর অঞ্চলে গমের আবাদ বেড়েছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় এবার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ছয় লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ লাখ টন গম উৎপাদনের ল্েয দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমিতে গমচাষ হয়েছে। এ অঞ্চলে এবার প্রায় সোয়া আট লাখ টন গম উৎপাদনের আশা করছে স্থানীয় কৃষক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো।

ব্র্যাক এক কর্মকর্তা বলেছেন, উত্তরাঞ্চলে এর আগে কখনও এত বেশি জমিতে গমচাষ হয়নি। এবার তিন লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। ফলনও প্রচুর হয়েছে।

বগুড়ার ইমপোর্টার মোস্তাক আহমেদ দুলাল ও আবদুল হামিদ জানান, ভারতীয় উন্নত মানের গম এখন ২৫.৩০ টাকা থেকে ২৫.৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশী কাঁচা গম ২২-২৩ টাকা এবং দেশী ভালো শুকনো গম ২৬-২৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও ও পাবনা বাজারে দেশী গম ২২-২৩ টাকা কেজিতে এবং ভালো জাত ২৫-২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক নয়া দিগন্তকে বলেন, কৃষক যে ফসল আবাদ করে কম ঝুঁকিতে বেশি মুনাফা পাবে, স্বাভাবিকভাবেই তারা সে ফসলটির চাষে আগ্রহী হবে। প্রতি বছর বোরোর উৎপাদন ভালো হলেও কৃষক তার কাক্সিত দাম পাচ্ছেন না। অনেক েেত্র তাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। অথচ গমচাষে এক দিকে যেমন ঝুঁকি ও উৎপাদন খরচ কম, তেমনি বাজারে গমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় সারা বছরই ভালো দাম পাওয়া যায়। তা ছাড়া দেশে গমের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় বিপুল গম বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। দেশেই যদি গমে উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে তিনি মনে করেন।

সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত (১১/০৪/২০১৩)   (আশরাফ আলী ও আতাউর রহমান মিলন)

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics