গাছ কি পারে পাথর হতে ??

জায়েদ ফরিদ  

গাছ কি কখনো পাথর হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর ও বিশ্লেষণ জটিল নয়। মাটি থেকে পাথরের সৃষ্টি হয়, আবার পাথর থেকেও কালক্রমে তৈরি হয় মাটি। আদিকাল থেকে প্রকৃতিতে এই বিপরীতমুখী রূপান্তর চলছেই, প্রাকৃতিক নিয়মে তা সময়সাপেক্ষ হলেও। একটি গাছ যখন মাটি চাপা পড়ে, আগ্নেয়গিরির ছাই চাপা পড়ে অথবা কাদার ভেতর আটকে থাকে দীর্ঘদিন তখন তার ভেতরে এক ধরনের অদৃশ্য ও অবিশ্বাস্য পরিবর্তনে পাথরের সৃষ্টি হতে পারে। এই শিলীভবন দেখা যেতে পারে প্রাণীর হাড় বা অনুরূপ বস্তূর ক্ষেত্রেও যা বৃক্ষের মতো ব্যাপক নয়।

1661789_10201987457621961_149002283_nএই পরিবর্তনের পরে গাছের চেহারা থাকে অবিকল আগের মতই, এমন কি বৃদ্ধি-বলয়গুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায় কিন্তু ভেতরের জৈব পদার্থের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সাধারণ দৃষ্টিতে যতই তাকে গাছ বলে মনে হোক আদতে তখন তা পাথর ছাড়া আর কিছু নয়। এমন রূপ নেবার পেছনে প্রধানত দুটো শর্ত থাকে। প্রথমতঃ গাছের শরীরে কোনো অক্সিজেনের সংস্পর্শ থাকতে পারবে না যাতে ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে গাছ পচে না যায়, আর দ্বিতীয়তঃ গাছের ভেতরে তথা উদ্ভিদ-কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে এমন কিছু খনিজ দ্রবণ যেমন বালি, ওপাল ইত্যাদির উপস্থিতি। এই পদ্ধতিতে দ্রবীভূত বালি ক্রমশ উদ্ভিদকোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং এক পর্যায়ে কোষের দেয়াল পর্যন্ত প্রতিস্থাপিত করে। এরপর শুকিয়ে পাথুরে স্ফটিকের আকার নেয়।1260851_10201987458781990_486422520_n

শুধু আকার নেয় তা নয়, বালি থেকে সৃষ্ট স্ফটিক রঙও ধারণ করে। বালির স্ফটিক বা কোয়ার্টজ্‌ বিশুদ্ধ হলে তা দেখতে স্বচ্ছ হয় কিন্তু এর সঙ্গে যদি ইম্পিউরিটি বা অপদ্রব্য মিশে থাকে তবে তাতে বিচিত্র রঙ দেখা দেয়। ম্যাঙ্গানিজ মিশ্রিত থাকলে তাতে রঙ হয় গোলাপি-বেগুনি যাকে আমরা এমেথিস্ট বলি, ব্যবহার করি কানের দুল, গলার হার বা অন্যান্য গহনা হিশেবে। তামা বা কোবাল্ট থাকলে এর রঙ হয় নীল-সবুজ আর লোহা থাকলে হয় লাল-হলুদ। বিশেষত চীনে এই শিলীভূত গাছ থেকে তৈরি হয় অনেক ধরনের আসবাব যা বেশ মূল্যবান।

পৃথিবীতে শিলীভূত বৃক্ষ পাওয়া যায় বেশ কিছু জায়গায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, আমেরিকা ও কানাডায় এর প্রাচুর্য আছে। সম্ভবত গ্রীসেই আছে সবচেয়ে বড় শিলীভূত অরণ্য বা পেট্রিফাইড ফরেস্ট (Petrified Forest) যার আয়তন ১৫০ বর্গ কিলোমিটার। এই ফসিল অরণ্যে শিলীভূত গাছের শেকড় পর্যন্ত দেখা যায়। এমন বৃক্ষারণ্য দেখার জন্যে বাংলাদেশের নিকটতম জায়গা হল ভারতের চেন্নাই। ন্যাশন্যাল সারভে অব ইন্ডিয়া ২৪৭ একরের এই অরণ্যটিকে সংরক্ষণ করছে থিরুভাক্কারাই নামক গ্রামে যেখানে রেড-ব্রাউন রঙের ২০০ গাছের ফসিল আছে, ৩ থেকে ১৫ মিটার লম্বা। 1606344_10201987461102048_264692115_oতবে এসব গাছের পাতা বা ছোট ডাল দেখা যাবে না কারণ শিলীভূত হবার আগেই তা পচে নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়া কোয়ার্টজ্‌ পাথর বেশ ভঙ্গুর হবার কারণে প্রায়ই তা টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে শিলীভূত অরণ্য না থাকলেও বিক্ষিপ্তভাবে মধুপুর, বরেন্দ্র ও ময়নামতি অঞ্চলে কিছু ফসিল গাছের টুকরো দেখেতে পাওয়া যায়, যা আঞ্চলিকভাবে অসুরের হাড্ডি নামে পরিচিত।

ভারতের চেন্নাই, আমেরিকার অ্যারিজোনা বা ব্রাজিলের সকল শিলীভূত বা প্রস্তরীভূত অরণ্যের কোনোটিরই বয়স দুই কোটি বছরের কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এতো দীর্ঘ সময় ছাড়া কি শিলীভবন হতে পারে না?

দেখা গেছে, খনির ভেতর যে সব কাঠ ব্যবহার করা হয় সেগুলো কয়েক বছরের মধ্যেই শিলীভূত হওয়া শুরু করে, কারণ খনির জলীয় দ্রবণে খনিজ পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। অস্ট্রেলিয়ার রত্ন সংক্রান্ত একটি ল্যাপিডারি পত্রিকায় ‘পিগট’ নামে একজন লেখক প্রকৃতিতে দ্রুত শিলীভূত হবার কিছু নজীর উল্লেখ করেছেন। কুইন্সল্যান্ডের একটি বাগানে কুড়াল দিয়ে কাটা গাছ মাটি চাপা পড়ার ৭০ বছর পর উঠিয়ে দেখা গেছে তা প্রস্তরীভূত হয়ে পড়েছে যাতে কুড়ালের দাগ পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় আছে। একটি কাঠের ফেন্স-পোস্টও উদ্ধার করা গেছে শিলীভূত অবস্থায় যার ভেতর তারকাঁটা এবং ছিদ্র দুটোই বর্তমান।1925290_10201987465182150_854927264_n

ইটালির সুন্দর নগরী ভেনিস জল ও কাদামাটির ওপর নির্মিত। ১৬২৯ থেকে ৩১ পর্যন্ত প্রায় ৩০ লক্ষ জীবন-অবসানকারী প্লেগের আক্রমণ শেষ হলে সেখানে নির্মান করা হয়েছে ‘সান্টা মারিয়া অব হেলথ্‌’ নামের একটি বিশাল গীর্জা যার নিচে প্রায় দুই লক্ষ সফট্‌-উড-এর পাইল করা হয়েছিল। এখন ফাউন্ডেশান পরীক্ষা করে জানা গেছে সে সব কাঠ পাথর হয়ে গেছে, এবং আরো বেশি ওজন নেবার ক্ষমতা অর্জন করেছে।

সমসাময়িক কালে নির্মিত হয়েছে আমাদের প্রিয় তাজমহলও, প্রতিবছর যার দর্শকের সংখ্যা অন্যুন ৪০ লক্ষ। কিন্তু ইদানিং তার অস্তিত্ব নিয়ে ভারত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তাজমহলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক রামনাথ করুণ স্বরে বলেছেন, যমুনা মরে গেলে তাজও মরে যাবে। পৃথিবীর অনেক ইমারতের মতো তাজমহলও তখন নির্মান করা হয়েছে কাঠের ফাউন্ডেশানের ওপর। অনেকে মনে করেন সে কাঠ মেহগনি গোত্রের, পানি শুকিয়ে যাবার কারণে যাতে পচন ধরেছে। ভেনিসের গীর্জার মত সে সব কাঠ নিশ্চয়ই শিলীভূত হতে পারেনি, কারণ তাজমহলের গায়ে ফাটল ধরেছে এবং মিনারগুলো হেলে পড়ছে।

বিখ্যাত টিম্বার বিশেষজ্ঞ এন্ড্রু লরেন্স বলেছেন, ফাউন্ডেশানে মেহগনি থাকবার কথা নয়, কারণ মেহগনি সে সময় আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। যমুনার জল নেমে যাবার কারণে যদি কাঠে উঁই পোকা আক্রমণ করে বা পচে যায় তবে যথাযোগ্য ব্যবস্থা না নেয়া হলে ৫ বছরের মধ্যেই এই অনুপম সপ্তাশ্চর্য ভেঙে পড়তে পারে। মেহগনি কাঠ পানিতে ডুবে থাকলে দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভাল থাকতে পারে কিন্তু সেগুন তার চেয়ে অনেক বেশি টিকসই যা মুগল সম্রাট শাহজাহান ব্যবহার করেছেন কি না তা আমাদের জানা নেই। এর একটি কারণ হয়ত, দীর্ঘকাল যাবৎ এর ফাউন্ডেশান খুঁড়ে দেখা হয়নি। যদি নিচের কাঠ শিলীভূত হতে পারতো তবে তাজ নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হত না আজ। হয়ত কোল-অয়েল বা অন্য কোনো রসায়ন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কাঠকে কৃত্রিম উপায়ে শিলীভূত করার কথা ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞানীদের বা প্রকৃতির গবেষণাগার, দুটো জায়গাতেই আমরা দেখতে পেয়েছি শিলীভূত করার পদ্ধতি সংক্ষিপ্তও হতে পারে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাডভান্সড্‌ সিরামিক ল্যাব’-এ এ নিয়ে বেশ গবেষণা হয়েছে। কানেকটিকাট-এর হ্যামিল্টন হিকস্‌ একটি পেটেন্টও সংগ্রহ করেছেন। তিনি দ্রবীভূত কাঁচ আর আগ্নেয় অথবা খনিজ-সমৃদ্ধ ঝর্ণার জল ব্যবহার করে এই শিলীভবনের দ্রুত-পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। যদি তা সুলভে বাণিজ্যজাত করা হয় তবে মানুষের জন্যে থাকবে অনেক কল্যাণ। এই উপায়ে তৈরি করা শিলীভূত কাঠ হবে লোহার চেয়েও শক্ত, কখনো ঘুণে ধরবে না, আগুনেও পুড়বে না এবং অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics