চুপ চুপ জলে ডুব দেয় পানকৌড়ি

নু-জাহাত-জাবিন।

আমাদের দেশের এক অতি পরিচিত পাখি পানকৌড়ি। পানকৌড়ি পাখির মজার ১টা বৈশিষ্ট হল এরা বেশির ভাগ সময়ে ডানা মেলে ঠায় বসে থাকে!! সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে এই পাখির ব্যাপক আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। তবে, হতাশার কথা হচ্ছে, কালের বিবর্তনে ,প্রকৃতির বিরূপ আচরণে, আর মনুষ্য অত্যাচারে পাখিটি আজ বিরল প্রায়।প্রায় হারিয়ে যেতে বসা আমাদের পানকৌড়ি নিয়ে কিছু তথ্য এবং ছবি।

পানকৌড়ি, বাংলা নাম-পানকৌড়ি আর ইংরেজি নাম— Cormorant। আমাদের দেশে ২ ধরনের পানকৌড়ি দেখা যায়। পানকৌড়ি এই দুটি প্রজাতির পাখির সাধারণ নাম। Phalacrocoracidae গোত্রের Phalacrocorax গণের অন্তর্গত এই দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে দেখা যায়। সাধারণভাবে এদের বলা হয় ছোটো পানকৌড়ি আর বড় পানকৌড়ি।দুটো প্রজাতি বড় পানকৌড়ি ও ছোট পানকৌড়ি এর মধ্যে বড় পানকৌড়ি অপেক্ষাকৃত বিরল।

ছবি--পানকৌড়ি
ছবি–পানকৌড়ি

ছোটো পানকৌড়ি
ইংরেজি নাম : Little Cormorant।
বৈজ্ঞানিক নাম :  Phalacrocorax niger

আকারের বিচারে এই পানকৌড়ি বেশ ছোটো বলে, একে ছোটো পানকৌড়ি বলা হয়। এই পাখি দেখা যায়— ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েৎনাম, ভুটান, মালোয়েশিয়া, মায়ানমার, লাওস, শ্রীলঙ্কা। এরা সাধারণত কোনো না কোনো জলাশয়ের ধারে এদের দেখা যায়। এরা প্রজননের সময় এরা গাছে বাসা তৈরি করে। এরা একবারে চার-পাঁচটি নীল-সবুজ বর্ণের ডিম পাড়ে।

এদের আকার কাকের চেয়ে একটু বড় এবং পালকের রঙ কালো। এদের ঠোঁট হাঁসের মতো বড় ও ছড়ানো এদের লেজ বেশ ছড়ানো থাকে। এদের প্রধান খাদ্য মাছ। এদের দৈর্ঘ্য ৫৫ সেন্টিমিটার এবং গড় ওজন ৪৪২.৫ গ্রাম।

চিত্র- ছোট পানকৌড়ি
চিত্র- ছোট পানকৌড়ি

বড় পানকৌড়ি

ইংরেজি নাম : Indian Cormorant বা Indian Shag।
বৈজ্ঞানিক নাম :  Phalacrocorax fuscicollis

ছোটো পানকৌড়ির চেয়ে একটু বড়। এই পাখি দেখা যায়— ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, ভারত। এরা সাধারণত কোনো না কোনো জলাশয়ের ধারে এদের দেখা যায়। এক সাথে ১০-১২টি দেখা যায়।কখনো কখনো একাও বসে থাকে।এদের দেহে কালোর ভিতর ছিটা সাদা রং দেখা যায়।

এরা দৈর্ঘ্যে ২০-২১ ইঞ্চি। এদের ঠোঁট হাঁসের মতো বড় ও ছড়ানো। এদের লেজ বেশ ছড়ানো থাকে। এদের প্রধান খাদ্য মাছ।  এরা একবারে তিন-চারটি নীল-সবুজ বর্ণের ডিম পাড়ে।

pankouri 3
চিত্র—বড় পানকৌড়ি

ছোট পানকৌড়ির ঠোঁট কিছুটা সাদা রং এর হয় কিন্তু, বড় পানকৌড়ির ঠোঁট পুরো কালো।

পানকৌড়ি আজ থেকে ৫০ বছর আগেও সারা বাংলাদেশে প্রচুর ছিল। গ্রামগঞ্জে ছোট-বড় বিল, ঝিল, জলাশয়, ধানক্ষেত, পুকুর, দীঘি, হাওর, বাঁওড়, ডোবা-নালা ও মজা নদীসহ সব জায়গাতেই ছিল ওদের অবাধ বিচরণ। জল আর মাছ যেখানে, ওরা ছিল সেখানেই। বর্তমানে কেবল বিল-বাঁওড়, হাওর, কাপ্তাই লেক এবং মোহনা বা খাড়ি অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। কারণ, বদলে গেছে ও যাচ্ছে সবকিছু। আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিজল-করচ-করুণ-গাছ পরিবেষ্টিত বিল-ঝিল-জলাশয়, যেখানে অবাধে বিচরণ করত ছোট ছোট নানা ধরনের মাছ। তা ছাড়া ফসলের মাঠে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জলজ পোকামাকড়, ব্যাঙ, মাছ ও মেটেসাপ কমে গেছে। খাদ্যোভাবে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে পানকৌড়ির বিচরণ স্থান।pankouri 4

পানকৌড়ি কালো কুচকুচে এক পাখি। গলার নিচে একটুখানি সাদাটে। চোখ লাল। লেজ লম্বা। পা খাটো, পায়ের পাতা হাঁসের মতো, ঘাড় লম্বা, শক্ত ঠোঁট মোটামুটি লম্বা।লম্বায় এরা ৩০-৩৩সে.মি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের গলা বেশ বড়। ওপরের ঠোঁটটা নিচের ঠোঁটের চেয়ে কিঞ্চিত বড়, এদের ঠোঁটের সামনের ভাগ বাঁকা। বড়শির মতো ধারালো ।মাথায় ঝুঁটি মতো পালক আছে। উত্তেজিত হলে জেগে যায়। কিন্তু বড় শান্ত পাখি। একসঙ্গে ৩ থেকে ২৫টি পর্যন্ত একদলে থাকে এবং দলবদ্ধভাবে শিকারে নামে। কিছুক্ষণ পানিতে থাকার পর ডাঙায় বা গাছের ওপর ডানা মেলে তা রোদে শুকাতে হয়।
মাছই পানকৌড়ির প্রধান খাবার। সে খাবার তারা পানিতে ডুবে ডুবে ধরে। পানির নিচে পানকৌড়ি ডলফিনের মতো স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে, পরিষ্কার পানির নিচে ২ মিটার পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পায়, ডুব দিয়ে প্রায় ১ মিনিট পানির নিচে থাকতেও পারে। ডুব দিয়েই যদি মাছ কিংবা খাবার পেয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠবে ভুস করে। কাকের চেয়ে বড় কালো এই পাখিটি জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরে বলে এদের ঠোট পা এবং লেজ হাঁসের মতো।

ছবি--- শিকার ধরার আগ মুহূর্ত
ছবি— শিকার ধরার আগ মুহূর্ত

পানকৌড়ির খাবার তালিকায় আছে শিং, মাগুর, বাইন, পুঁটি, টেংরা ইত্যাদি ছোট ও মাঝারি মাছ, ছোট শোল-গজাল, টাকি, ছোট শামুক, জল-মাকড়সা, জলজ কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, ছোট জলসাপ ইত্যাদি। পাবদা-সরপুঁটি ওদের প্রিয় খাবার। খিদে বেশি। বাচ্চাদের খাই-খাই ভাব থাকে।

প্রজনন

বর্ষা মৌসুম পানকৌড়ির বাসা বাঁধার ঋতু। গ্রামের উঁচু তেঁতুল, আম বা জামগাছ এদের প্রিয়। কয়েক জোড়া পানকৌড়ি, বক সঙ্গে মিলে একই গাছে বাসা বাঁধে, অথবা কেবল একাই একটি গাছ দখল করতে পারে। পরপর কয়েক বছর এরা একই জায়গায় বাসা করে। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ৪-৬ দিন।বাসা অন্য পাখির মত শিল্পের হয় না। মেয়ে পানকৌড়ি ডিম পাড়ে ৪-৫টি। পুরুষ-স্ত্রী পালা করে ডিমে তা’ দেয়। ডিম ফোটে ২৭-২৯ দিনে। ৩৫-৪০ দিনে বাচ্চারা উড়তে শেখে।
কিন্তু ডানা গজানোর পর থেকেই ওরা উড়তে চেষ্টা করে। উড়তে শেখার পর মা-বাবা বাচ্চাদের ডুব-সাঁতারের ট্রেনিং দেয়। পেটে করে মাছ এনে তা বাসায় বমি করে ঢেলে দেয় এবং বাচ্চারা খায়।pankouri 6

পানকৌড়ি মেয়ে-পুরুষ দেখতে একই রকম। ওদের ডাক শোনা খুব দুরূহ ব্যাপার। কেবল বাসা বাঁধার সময় ওরা ডাকে। কর্কশ স্বর। জোরালো নয়। অনেকটা চাপা কাশির আওয়াজের মতো হুপ-হুপ ধরনের। ক্রমাগত জলাশয় ভরাটের কারনে হারিয়ে যেতে বসেছে পানকৌড়িরা। এখনই সময় সচেতনতার। পানকৌড়ি বাঁচাতে সবাই এগিয়ে আসুন।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি

চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics