জলবায়ু পরিবর্তনঃ ভাবনার অবকাশে পুরনো কথা

সাইফুর রহমান সুমন

জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোন নতুন ইস্যু নয়। বিষয়টি এখন গ্লোবাল ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন ও এ সংক্রান্ত পরিবেশগত সমস্যা বর্তমানে প্রকট আকার ধারন করেছে। চারদিকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত অনেক ধরনের লেখালেখি, আলোচনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা ধরনের সেমিনার, সম্মেলন ও প্রটোকল তৈরী হলেও এ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপ তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখেনি। environmentmove.earth এর নেওয়া উদ্যোগে এ বিষয়ে ধারাবাহিক ফিচার ও প্রতিবেদন প্রকাশের আজকের প্রথম পর্বে আপনাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তন ও এ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সেমিনার, সম্মেলন ও প্রটোকল এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক যত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বা হয়ে আসছে তা আমাদের পরবর্তী ধারাবাহিক পর্বের মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।1

জলবায়ু পরিবর্তন (climate change) বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে যে জিনিষটি তুলে ধরে, তা হল – একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাস ইত্যাদি সূচকের পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং একই সাথে দেখা দিচ্ছে পৃথিবী পৃষ্ঠে এর মারাত্মক প্রভাব। উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে বিদ্যমান, দেখা দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি, তারসাথে পাল্লা দিয়ে হ্রাসবৃদ্ধি হচ্ছে দুই মেরুর হিমবাহের আয়তন। এই পরিবর্তনের সময়কাল কয়েক দশক থেকে কয়েক মিলিয়ন বছর হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টির সাথে যে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হল – গ্রীণ হাউজ গ্যাস, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। প্রত্যেকটি বিষয় একটির ফলশ্রুতিতে অপরটি চলে আসে।

 বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানীদের ও পরিবেশবাদীদের ঘুম নষ্ট করে দেওয়া “জলবায়ু পরিবর্তন” এর বিষয়টির নেপথ্যে কালো হাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে “গ্রীণ হাউজ গ্যাস” যে যৌগিক গ্যাসীয় পদার্থসমূহ গ্রীণ হাউজ গ্যাস সৃষ্টির জন্য দায়ী তা হচ্ছে মূলত মিথেন গ্যাস, ওজোন গ্যাস ও ক্লোরোফ্লোরোকার্বনসমূহ । এছাড়াও রয়েছে সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি। আমাদের বায়ুমণ্ডলে এ সমস্ত গ্রীণ হাউজ গ্যাস সৃষ্টির মূল উৎস হিসেবে কলকারখানার কালো ধোঁয়া, মোটর চালিত যানবাহন নির্গত গ্যাস, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, এরোসল প্রভৃতি তৈরিতে ব্যাবহার করা ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বিশিষ্ট গ্যাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গ্রিণ হাউজ গ্যাস তৈরি করছে বায়ুমণ্ডলের চারপাশে একধরনের স্তর, যা সূর্য থেকে আসা তাপকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আটকে পড়া এই তাপ পৃথিবীকে করে তুলছে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর। IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একুশ শতকে গ্রীণ হাউজ গ্যাস এর সর্বনিম্ন নির্গমনে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.১ থেকে ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ নির্গমনে ২.৪ থেকে ৬.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। পাশাপাশি গত কয়েক দশক ধরে গলছে দুই মেরুর বরফ। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলা এই পানি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। প্রগতিপন্থী অনেকেই মনে করেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি গালগল্প, কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত এর সত্যতা প্রমাণ করে বিভিন্ন ভিডিওচিত্র, ভূ-উপগ্রহচিত্র, আলোকচিত্র ও বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ হাজির করছেন। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে হুমকির মুখে রয়েছে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলসমূহ। এর মধ্যে উল্লেখ করে বলা যায়, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসমূহ অচিরেই সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। UNFCCC (United Nations Framework Convention on Climate Change) এর দেয়া তথ্য মতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২০১১ নাগাদ তা ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে। মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে রয়েছে সমুদ্র উপকূলবর্তী নিম্নাঞ্চলসমূহ এবং এই অঞ্চলের মানুষ ও জীববৈচিত্র্য। দিন দিন কমে আসছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। ফলশ্রুতিতে খাদ্য নিরাপত্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক হুমকির বিষয়। নানা ধরনের প্রজাতি হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ আবাসস্থল ও খাদ্য। বিশৃঙ্খলার চরম পরিনতি অবলোকিত হচ্ছে পরিবেশের খাদ্য জালে (Food web)। জলবায়ু পরিবর্তনের এ এক চরম মাশুল গুণতে হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতি বিলীন হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আর এর পিছনে মূল কারণ হিসেবে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীরা বলছেন অবাধে বনভূমি নিধন এবং ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের কথা।

2

যে বিষয়টি এখন বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন – বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি সহ সামুদ্রিক লোনা পানির মিঠা পানিতে অন্তর্গতকরণ যা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন মহাদেশীয় অঞ্চলের বিগত কয়েক দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, পূর্বের তুলনায় শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বলা হয়ে আসছে পরিবেশগত অস্থিতিশীলতার কথা। পরিবেশবাদী ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমান সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও এ থেকে উদ্ভূত খাদ্য, পানি ও আবাসস্থল নিরাপত্তাহীনতা সমস্যা।

প্রযুক্তির এই যুগে আমরা যেমন একদিকে নগরায়ন ও শিল্পায়নে এগিয়ে যাচ্ছি, তেমনি অপরদিকে পরিবেশের জন্য ডেকে আনছি মারাত্মক বিপর্যয়। জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে মানব সৃষ্ট কারণই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিজেই মানব সভ্যতা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি। হুমকির মুখে রয়েছি আমরা নিজেরাও। দিন দিন একটু একটু করে নিজেদেরকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি বিরুপ পরিবেশের কড়াল থাবায়। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের প্রয়োজন এখনই জরুরিভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ। পদক্ষেপগুলো নিতে হবে উচ্চতর পর্যায় থেকে শুরু করে নিম্নতর পর্যায় পর্যন্ত।  এখনই যদি এ ব্যাপারে জরুরিভিত্তিতে গুরুত্ব আরোপ না করা হয় তবে ক্রমশঃই আমরা আমাদের প্রিয় ধরণীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলব। আমরা কি পারব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বসবাস উপযোগী পরিবেশ এই ধরণীর বুকে রেখে যেতে, প্রযুক্তিবাদী, প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে আমাদের আজকের পর্বের এখানেই ইতি টানছি।

মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics