
টিলাগড় ইকোপার্ক – জীববৈচিত্র্যের আধার
রাহুল দাশ তালুকদার
আধ্যাত্মিক নগরী হিসেবে সিলেটের ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে।শহরের প্রাণ কেন্দ্রে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার, শহরের প্রান্তে শাহ পরানের, আর পুরো শহর জুড়েই ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট অনেক মাজার। তাছাড়া, সবুজের শহর হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে এশহরের। পাহাড়, টিলা,ছোট আর বড় নদী হয়তো ছড়িয়ে নয়তো জড়িয়ে রেখেছে প্রাণের শহর সিলেটকে। কিন্তু সময়ের সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসত বাড়ি নির্মাণ ও গড়ে ওঠা বহুতল ভবন গ্রাস করেছে এ সবুজকে। সবুজের দেখা এখন শহরে মেলা ভারী দুস্কর। তবে ইট-কাঠের দালানের ব্যস্ত এ নগরীতে এখনো সবুজকে বুকে ধরে আছে টিলাগড় ইকোপার্ক। একখন্ড সবুজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে নিতে পর্যটকদের হাতছানি দেয় বিচিত্র প্রাণী আর উদ্ভিদে সমৃদ্ধ সবুজের সমারোহ এ ইকোপার্ক।
সিলেট জেলা সদর থেকে পূর্ব দিকে আট কি.মি. দূরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-সংলগ্ন টিলাগড় রিজার্ভ ফরেস্টের ১১২ একর জায়গা নিয়ে ২০০৬ সালে স্থাপন করা হয় টিলাগড় ইকোপার্ক। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলা হয় এই ইকোপার্ক।টিলাগড় ইকোপার্কে প্রায় ৫০ প্রজাতির বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ রয়েছে যার মধ্যে শাল, গর্জন, চাপালিশ, নাগেশ্বর, আগর, বকুল, হিজল, সেগুন, চাম্পা, জারুল, ঝাউ, জলপাই, চালতা, বাজনা, ডুমুর, আম, জাম, কাঁঠাল, মিনজিরি, বট, আকাশমনি, ম্যানজিয়াম, মেহগনি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রায় ৩০ প্রজাতির প্রাণীও রয়েছে ইকোপার্কটিতে।

এর মধ্যে মেছোবাঘ, বাগডাশ, শিয়াল, বানর, কাঠবিড়ালি, শজারু, খেঁকশিয়াল, খরগোশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইকোপার্কের ভিতর দিয়ে একটি ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। পার্কের ভেতরে যত দূর যাওয়া যায়, চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঘন সবুজের মাঝে হারিয়ে যান ঘুরতে আসা পর্যটকরা। পার্কের আম, জাম, কাঠাল বা দীর্ঘাকৃতি শাল, সেগুন আর মেহগনী গাছের ডালে বানর ও কাঠবিড়ালির লাফালাফি মুগ্ধ করে পর্যটকদের। পার্কের ভেতরে নানা প্রজাতির পাখি বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে থাকছে পর্যটকদের জন্য। পাখির মধ্যে রয়েছে মথুরা, ময়না, টিয়া, ঘুঘু, হরিকল, সাতভাই চম্পা ইত্যাদি। পাখির কিচির মিচির ডাক আর জঙ্গলে শেয়াল-বনবিড়ালের দৌঁড়ঝাপ পর্যটকদের মোহিত করে। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলতে পারে মেছোবাঘ, বাগডাশ, খরগোশ, সজারু, হনুমান ও বনমোরগের।
তবে উদ্বেগের বিষয় এই যে, টিলাগড় ইকোপার্কের সংরক্ষিত বন আজ সুরক্ষিত নয়। কিছুদিন আগে রাতের আঁধারে নগরীর টিলাগড় ইকোপার্কে গাছ চুরির খবর পাওয়া গেছে। রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায় অবর্তীণ হওয়ায় এসব চুরির ঘটনা ঘটছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সিলেট বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বনবিভাগের টিলাগড় বনবিটের আওতাধীন ইকোপার্কের চম্পা বাগানের উত্তর পশ্চিম পাশের কয়েক লাখ টাকা মূল্যের ১০-১৫ টি শাল, গর্জন ও চম্পা গাছ রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। প্রায় চার মাস আগে গাছ চুরির সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে সৈয়দ হামিদুর রহমান নামের এক বনপ্রহরীকে টিলাগড় ইকোপার্ক থেকে প্রত্যাহার করা হলেও এখনো থেমে নেই গাছ চুরি। ইকোপার্কের ভেতরের দিকের বনে এসব চুরি বেশি হচ্ছে। কিছুদিন আগেই সরেজমিনে টিলাগড় ইকোপার্কের চম্পাবাগানে গিয়ে দেখা গেছে গভীর বনের ভেতর সদ্য কাটা ৮-১০টি গাছের মুথা (গুড়ি) বের হয়ে আছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে স্থানীয় একটি চোরচক্র এই গাছ চুরি করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
যে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠিত সে জীববৈচিত্র্য আজ বিনষ্ঠিত হচ্ছে। ইকোপার্কের ভেতরে স্থাপনা নির্মাণ, জনসাধারনের অবাধ বিচরণ, জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে বণ্যপ্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে আশংকাজনক হারে কমছে বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ ইত্যাদি। তাছাড়া কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম এই ইকোপার্ককে তাদের শীতকালীন মহড়ার স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ফায়ারিং ও বোমার বিকট শব্দে যেখানে মানুষের ঘুম হারাম সেখানে নিরীহ বণ্যপ্রাণীগুলোর কি অবস্থা হয়েছিলো একবার ভেবে দেখুন! সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এরকম সামরিক মহড়ার প্রতিবাদ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন “ গ্রীন এক্সপ্লোরার সোসাইটি”, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার সংরক্ষন বিষয়ক সংগঠন “প্রাধিকার” এবং ভবিষ্যতে এরকম মহড়া না করার ও প্রতিশ্রুতি দেন সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয় ইকোপার্কের ভেতরে যানবাহনের অবাধ আনাগোনা, অপরিকল্পিত জনবসতি, মাদকাসেবী ও ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বন্যপ্রাণীর জন্য যেমন হুমকিস্বরূপ তেমনি বনের পরিবেশ জন্য ও ক্ষতিকারক। সবচেয়ে বড় কথা, ইকোপার্কের সংরক্ষিত বনে কোন সুনির্দিষ্ট বেষ্ঠনী না থাকায় লোকজনের অবাধ বিচরন বেড়েই চলছে। এতে করে প্রাণীদের আবাসস্থল অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
প্রাণীঅধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকারের উপদেষ্টা ড. সায়েম উদ্দিন আহমেদ বলেন ‘‘ টিলাগড় ইকোপার্ক জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য আধার। সঠিক রক্ষনাবেক্ষণ ও পরিচর্যার ফলে সিলেট অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর এক নিরাপদ অভয়াশ্রম হয়ে উঠতে পারে এই ইকোপার্ক। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সঠিক সীমানা নির্ধারন ও সেখানে জনসাধারনের প্রবেশাধিকারের নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করলে বন্যপ্রাণীরা ও নিরাপদ আশ্রয় পাবে সাথে সাথে আমরা পাবো সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ’’।
লেখকঃ সভাপতি, প্রাধিকার