
ঢাকার ৯৫ শতাংশ লিচু ও ১০০ ভাগ জাম ফরমালিনযুক্ত
ঢাকার বাজারে মৌসুমী সুস্বাদু ও তৃপ্তিদায়ক ফলের সমাহার থাকলেও এসব ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল তথা ফরমালিনের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নতা কাটছে না ক্রেতা সাধারণের। ফল সংরক্ষণ এবং পাঁকাতে ব্যবসায়ীরা ফলে অহরহ ব্যবহার করছে বিষাক্ত ক্যামিকেল। এই বিষাক্ত ফল গ্রহণের ফলে গলায় ও ফুসফুসে ক্যান্সার, রক্ত ক্যান্সারসহ কিডনী, ত্বক, মুত্রস্থলী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশু ও মহিলারা, গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকা থাকে। ফলের বাজারে বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল জরিমানা করলেও জনমনে আতংক কাটছে না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) মহানগরী ঢাকার বিভিন্ন স্থানের আম ও মৌসুমী ফলের ১ জুন থেকে ১০ জুন ২০১৩ পর্যšত দশদিনব্যাপী ফরমালিন পরীক্ষা করে। মাঠ পর্যায়ে ফরমালিন পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন আজ ১১ জুন ২০১৪, বুধবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দেখা যায় ঢাকার বাজারে মৌসুমী ফলের ৯৫ শতাংশ লিচু ও ১০০ শতাংশ জাম ফরমালিনযুক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের আলোকে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন-পবা’র নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, সম্পাদক এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, নাসফের সাধারণ সম্পাদক তৈয়ব আলী, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়- প্রতিটি ভোক্তার নিরাপদ ও ভোজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে । কিন্তু আমরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছসহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
ফরমালিন পরীক্ষার ফলাফল
ঢাকা মহানগরে মৌসুমী ফলে ফরমালিনের বর্তমান অবস্থা নিরুপণের লক্ষে ০১ থেকে ১০ জুন ২০১৪ পর্যšত আম, লিচু, জাম, আপেল, আঙ্গুর ও মালটায় ফরমালিনের পরিমাণ পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা মহানগরীর ৩৫টি এলাকা থেকে আমের ১২৮টি, লিচুর ২১টি, জামের ১৪টি, আপেলের ৩৯টি, আঙ্গুরের ৮টি এবং মালটার ১৬টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব ফল বিভিন্ন বাজার ও এলাকা হতে ক্রয় করে পবা কার্যালয়ে ত-৩০০ ঋড়ৎসধষরফবযুফব গবঃবৎ দ্বারা পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়-
আমের ১২৮টি নমুনার মধ্যে ৮৪টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে (০.১০ – ১৩.৬৭ পিপিএম), যা মোট নমুনার ৬৫.৬৩ শতাংশ; ৪৪টি নমুনায় ফরমালিন অনপুস্থিত, যা মোট নমুনার ৩৪.৩৭ শতাংশ।
লিচুর ২১টি নমুনার মধ্যে ২০টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে( ০.৭৬ – ২২.১২ পিপিএম), যা মোট নমুনার ৯৫.২৪ শতাংশ; ১টি নমুনায় ফরমালিন অনপুস্থিত, যা মোট নমুনার ৪.৭৬ শতাংশ।
জামের ১৪টি নমুনার মধ্যে ১৪টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে(০.১৩ – ৬৮.৬৪ পিপিএম), যা মোট নমুনার ১০০ ভাগ।
আপেলের ৩৯টি নমুনার মধ্যে ২৩টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে (০.১০ – ৬.৪২ পিপিএম), যা মোট নমুনার ৫৮.৯৭ শতাংশ; ১৬টি নমুনায় ফরমালিন অনপুস্থিত, যা মোট নমুনার ৪১.০৩ শতাংশ।
আঙ্গুরের ৮টি নমুনার মধ্যে ৭টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে (১.০০ – ১৬.০৮ পিপিএম), যা মোট নমুনার ৮৭.৫০ শতাংশ; ১টি নমুনায় ফরমালিন অনপুস্থিত, যা মোট নমুনার ১২.৫০ শতাংশ।
মালটার ১৬টি নমুনার মধ্যে ১১টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে( ০.১৭ – ৩০.০২ পিপিএম), যা মোট নমুনার ৬৮.৭৫ শতাংশ; ৫টি নমুনায় ফরমালিন অনপুস্থিত, যা মোট নমুনার ৩১.২৫ শতাংশ।
এছাড়া জামরুল, পেয়ারা, আনারস ও লেবুতে ফরমালিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয় এবং এসব ফলে ফরমালিন পাওয়া যায়। এমনকি সবজিতেও ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে। সবজির মধ্যে টমেটোতে ফরমালিনের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশী। তরল দুধেও ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে।
এনবিআর – এর তথ্য অনুযায়ী ২০১০-১১, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থ বছরে যথাক্রমে ২৬৯ টন, ২০৫ টন ও ৫৫ টন ফরমালডিহাইড আমদানি করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থ বছরে কোন ফরমালিন আমদানী করা হয় নি। শিল্প খাতে ফরমালডিহাইডের চাহিদা ৪০-৫০ টন। অবৈধপথে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফরমালিন আসছে। তাছাড়া আমদানি করা পণ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি তদারকি করা হচ্ছে না। এ কারণে আমদানি করা পণ্যেও ফরমালিন ধরা পড়ছে।
পবার পক্ষথেকে সমস্যা মুকাবিলায় নিম্নোক্ত শুপারিশসমূহ উপস্থাপন করা হয়-
খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মিশানোর সাথে জড়িত ও ফরমালিনযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়। এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ জরুরীভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা।
কোন রকম রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।
পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিন পরীক্ষা করা।
ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করার জন্য আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন ।
গণমাধ্যমে প্রচার- প্রচারণার মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ফরমালিনের বিষয়ে সচেতন করা।