তামাক চাষ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
সুপ্রিয়া সরকার
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ মূলত কৃষি নির্ভর একটি দেশ। এদেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। তবে বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কৃষকরা অধিক মুনাফার জন্য প্রথাগত চাষাবাদ থেকে বেরিয়ে ভিন্নরকম শস্য বা ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। তবে তাদের এই উদ্যোগ যে সম্পূর্ণভাবে প্রশংসার যোগ্য, তা কিন্তু নয়! তেমনি এক ক্ষেত্র হচ্ছে তামাক চাষ। অধিক মুনাফা লাভ করা গেলেও তামাক চাষ আদতে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তামাক গাছের শুকনো পাতা থেকে তামাক উৎপন্ন করা হয়। ইংরেজী Tobacco শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Tobaco থেকে। ধারনা করা হয় শব্দটির উৎপত্তি ‘আরাওয়াকান’ ভাষা থেকে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ‘তাইনো’ ভাষাতে একে ধূমপানের নল বোঝায়। স্প্যানিশ ও ইতালিয় ভাষাতে এর অর্থ ওষধি। তামাকের উৎপত্তি উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকায়। তামাক দিয়ে সিগারেট, চুরুট, বিড়ি, হুকো প্রভৃতি প্রস্তুত করা হয়। ধূমপান ছাড়াও জর্দা, খৈনি, নস্যি হিসেবেও তামাক ব্যবহার করা হয়।
তামাকের মূল নেশাদায়ক পদার্থ নিকোটিন নামক এক প্রকারের স্নায়ুবিষ,যা অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরের উপর কাজ করে। নিকোটিন ছাড়াও এতে ক্যান্সারপ্রদায়ী বহুচক্রী অ্যারোমেটিক যৌগ বেঞ্জোপাইরিন থাকে।
ব্যাপক হারে তামাকের চাষ বাংলাদেশের কৃষি জমির উপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে আবাদী জমির পরিমান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর আবাদী জমির পরিমান ছিল প্রায় ২ কোটি ১৭ হাজার হেক্টর, যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে ১৯৮৬ সালে ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর এবং ২০০৩ সালে এসে তা দাড়িয়েছে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ১ শতাংশ করে কৃষি জমির পরিমান কমে যাচ্ছে। তামাকের বৃদ্ধিরত উৎপাদন এই হ্রাসকরনের একটি অন্যতম কারন। দেশের তামাক চাষে প্রসিদ্ধ স্থান পার্বত্য অঞ্চলসমুহ,যেমন- রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, থানচি, নাইক্ষ্যাংছড়ি, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, রামু, চকোরিয়া প্রভৃতি এলাকায় তামাকের চাষ বেড়েই চলেছে। উল্লেখ্য বান্দরবান জেলায় গত ৪ বছরে তামাক চাষ ১৯৪১ গুন বেড়েছে। কুষ্টিয়ায় আবাদী জমির সিংহভাগই তামাক চাষে ব্যবহার করা হয়। রামুতে ৪ হাজার একর, চকোরিয়ায় ৩ হাজার একর, লামাতে ৫ হাজার একর ফসলি জমিতে তামাকের চাষ করা হয়। কৃষি জমি ছাড়াও বিভিন্ন সরকারী খাস জমি, রাস্তার দ্বার, বাড়ির আঙ্গিনায়, সবজী বাগান প্রভৃতি স্থানগুলোতেও তামাক চাষের প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তামাক চাষের উচ্চ মুনাফার জন্য কৃষকরা সাম্প্রতিক সময়ে তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিভিন্ন তামাক পন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কৃষকদের তামাকের বীজ, সার, কীটনাশক ও পরিচর্যাসহ সকল ব্যয় সুবিধা প্রদান করে। এর ফলে কৃষকরা শুধুমাত্র শ্রমের বিনিময়ে এত অধিক অর্থ আয়ের সুযোগ পাওয়ায় তামাক চাষের দিকে আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়াও ২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের নিয়ন্ত্রন আইনে চাষীদের বিকল্প ফসল উৎপাদনে ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি এবং নীতি অনুযায়ী ২০১০ সালে তার মেয়াদ শেষ হওয়ায় কৃষক তার আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য তামাক চাষে বাধ্য হচ্ছে।
তামাক চাষে পাতার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য জমিতে অধিক ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়, যার ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অন্য সারের কার্যাবলিও কমে যায়। এছাড়া জমির পানি ধারন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সেখানে পরবর্তীতে রবিশস্য উৎপাদন ব্যহত হয় এবং মাটিক্ষয় বৃদ্ধি পায়। তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবনে ও তামাক পোড়ানোয় সৃষ্ট ধোঁয়া মানুষের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার প্রভৃতি মরনঘাতী রোগ সৃষ্টি করে। সাধারনত তামাক চাষী ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ‘গ্রীণ টোবাক্কো’ ডিজিজ পরিলক্ষিত হয়।
তামাক চাষ শুধুমাত্র খাদ্য ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্যের অবনতির জন্যই দায়ী নয়, বরং তা বনাঞ্চল ধ্বংসেও যথেষ্ট অবদান রাখে। তামাক বাজারজাতকরণের জন্য তামাক পাতা পোড়ানো হয় এবং পরে তা প্যাকেটজাত করা হয়। সাধারনত ৪০ শতাংশ জমির তামাক পোড়ানোর জন্য প্রায় ৫০ মন কাঠ পোড়ানো হয়, যা বনাঞ্চলের গাছের উপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এতে দেখা যাচ্ছে তামাক প্রক্রিয়াকরনে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশের উপর। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও অত্যধিক মুনাফার কারনে তামাক চাষ বেড়েই চলেছে। গত অর্থ বছরে তামাক রপ্তানীর ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ রপ্তানী শুল্ক আরোপ করা হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সৎবিৎ ফেরেনি।
সর্বোপরি তামাক চাষ আমাদের খাদ্য উৎপাদন, ফসলি জমি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তামাক চাষ বন্ধে সরকারকে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্যথায়, তামাকের কালো ছায়া গ্রাস করবে আমাদের এই সুজলা, সুফলা , শস্য শ্যামলা সোনার বাংলাদেশকে।